21860

05/09/2025

দীঘিপাড়া খনিতে আড়াই লাখ কোটি টাকার কয়লা

বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2023-05-18 23:08:28

দিনাজপুরের দীঘিপাড়া কয়লা খনিতে বিভিন্ন স্তরে যে পরিমাণ কয়লা মজুত আছে তা থেকে ৩০ বছরে ৯ কোটি মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। যার বর্তমান বাজার মূল্য আড়াই লাখ কোটি টাকা।

সম্প্রতি শেষ হয়েছে এর চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ। এখন কেবল প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির অপেক্ষা। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলেই শুরু হবে এ কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের কাজ।  

২০১৬ সালে দেশের অভ্যন্তরে ৫টি কয়লা খনির মধ্যে মজুতের হিসাবে দ্বিতীয় বৃহত্তম দিনাজপুর দীঘিপাড়ার খনি থেকে কয়লা তোলার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। দেশের কয়লা উত্তোলন সক্ষমতা ৪০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করার লক্ষ্যে ২০১৭ সালেই শুরু হয় এর সম্ভাব্যতা যাচাই। এই দায়িত্ব দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি কোম্পানিকে (বিসিএমসিএল)। পরে শেষ হয় এর চূড়ান্ত সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ। 

সম্ভাব্যতা যাচাই তথ্য অনুযায়ী, এই কয়লা ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে যে পরিমাণ কয়লা মজুত আছে তা থেকে ৩০ বছরে ৯ কোটি মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। যার বর্তমান বাজার মূল্য আড়াই লাখ কোটি টাকা। এখানে সর্বোচ্চ ৪৩৪.৪৯ মিটার ও সর্বনিম্ন ৩২৩ মিটার গভীরে ৭২.৩৬ মিটার পুরুত্বের কয়লা আছে। এছাড়াও খনিতে রয়েছে সাদা মাটি, বালু মিশ্রিত সিলিকা যা গ্লাস ফ্যাক্টরিতে এবং সিরামিক কাজে ব্যবহার করা যাবে। এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি পেলেই এখানে কয়লা উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

জানা গেছে, দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ ও হাকিমপুর উপজেলার দীঘিপাড়ায় এই কয়লা খনিটি ১৯৯৫ সালে আবিষ্কার করে ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তর (জিএসবি)। এর উন্নয়নে ২০০৫ সালে সংশ্লিষ্ট বিভাগ পেট্রোবাংলাকে লাইসেন্স প্রদান করে। পরে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য খনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের প্রতিষ্ঠান ফুগরো, জার্মানির প্রতিষ্ঠান মিবরাগ কনসালটিং ইন্টারন্যাশনাল ও অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রাঞ্জ পিনকক মিনারকো এই তিন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে কনসোর্টিয়াম গঠনের পর তাদের সঙ্গে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের চুক্তি হয়।

চুক্তিতে জরিপ সম্পাদন কাজে মোট ব্যয় ধরা হয় ১৬৭ কোটি টাকা। চুক্তির মেয়াদ ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত। এ সময় তারা সকল তথ্য সংগ্রহ করে তৃতীয় মাত্রার ভূ-কম্পন (থ্রি-ডি সিসমিক), অধিকতর জরিপ, টপোগ্রাফিক সমীক্ষা, অনুসন্ধান কূপ খনন, খনির নক্সা এবং প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে। যা চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তিনি বলেন, আমদানিনির্ভরতা কমাতে আমরা শুরু থেকেই দেশীয় কয়লা উত্তোলনের লক্ষ্যে কাজ করছিলাম। আর এ জন্যই দীঘিপাড়া কয়লা খনি বাস্তবায়নে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর সব ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই কাজ শেষ। বড়পুকুরিয়ার মতোই দীঘিপাড়া কয়লা খনিতে ভূ-গর্ভের সুড়ঙ্গ ব্যবস্থার মাধ্যমে কয়লা উত্তোলন করা হবে। কারণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে অনেক বড় এলাকা অধিগ্রহণ করতে হবে। যা আপাতত সম্ভব নয়। তাই সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতেই এখানে কয়লা উত্তোলন করা হবে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতির ওপর। দেশের ইতিহাসে এমন একটি বড় কাজের অনুমতি নিশ্চয়ই তিনি দেবেন। এর পরই আমরা কাজ শুরু করতে পারব বলে আশা করছি। 

দীঘিপাড়া কয়লা খনি বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানান, আমরা ইতোমধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে অপেক্ষা করছি। খনি বাস্তবায়ন এখন নির্ভর করছে সরকারের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকদের ওপর। সরকার চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেই পেট্রোবাংলার মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ, আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করে খনি উন্নয়ন ও কয়লা উৎপাদনের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। 

দেশে বর্তমানে পাঁচ খনিতে ৭ হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুত রয়েছে বলে তথ্য জ্বালানি বিভাগের। যে ক’টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে বা নির্মাণাধীন রয়েছে সেগুলোর দীর্ঘ সময়ের জ্বালানি হিসেবে এই মজুত কয়লা ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু বিশাল মজুত সত্ত্বেও এ পর্যন্ত দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য কোনো খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করেনি সরকার। এই খনিটি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কার হয়। এখানে প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত রয়েছে। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। খনির পাশেই স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা পূরণ করছে এ কয়লা।

দীঘিপাড়ায় প্রাথমিক জরিপে ভূগর্ভের ৩২০-৫০৬ মিটার গভীরতায় উন্নত মানের বিটুমিনাস কয়লার সন্ধান পাওয়া যায়। এই কোল বেসিনে ১১.০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মোট ৭০৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লার মজুত রয়েছে। মোট ১১টি কোল সিম, তার মধ্যে ৩টি সিম উল্লেখযোগ্য পুরুত্বের (সিম সি, বিস্তৃতি ১০.৫০ বর্গকিলোমিটার, পুরুত্ব ৩১.৬৯ মিটার, ভূতাত্ত্বিক মজুত ৪২৮ মিলি. মেট্রিক টন, সিম সি, বিস্তৃতি ১১.০০ বর্গকিলোমিটার, পুরুত্ব ৯.৯৫ মিটার, ভূ-তাত্ত্বিক মজুত ১৩৯ মিলি, মেট্রিক টন)।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মাল্টিস্লাইস লংওয়াল টপ কোল কেভিং মেথড পদ্ধতিতে মাইনিং করার সুপারিশ করেছে। মাল্টিস্লাইস এলটিসিসি পদ্ধতিতে মাইনিংয়ের জন্য ৬টি স্লাইস  নির্মাণ করা হয়েছে। যার প্রতিটি গড় পুরুত্ব ৭.২০। খনির নির্মাণ কাল ১২ বছর তবে নির্মাণ শুরুর ৮ বছর পর হতে আংশিক উৎপাদন শুরু হবে। খনি নির্মাণকালের ৪ বছর আংশিক উৎপাদনকালসহ মোট উৎপাদনকাল ৩৫ বছর। খনির পূর্র্ণাঙ্গ নির্মাণ শেষে  পরবর্তী ৩১ বছর বার্ষিক ২.৮ মিলিয়ন মে. টন (সর্বনিম্ন ১.৭০ মিলিয়ন, মে. টন থেকে সর্বোচ্চ ৩.৪৯ মি. মে. টন গড় উৎপাদন সম্ভব বলে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মত প্রকাশ করেছে।

আর্থিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী খনি নির্মাণে ১,৬৪৪.০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূলধনী (ক্যাপিটাল) ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজন হবে। কয়লার টনপ্রতি বিক্রয় মূল্য ১৭৬ মার্কিন ডলার, রেট অব রিটার্ন ৯.৭% এবং ডিসকাউন্ট রেট ৮% ধরে এনপিভি ১৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে।

দেশে নির্মিত ও নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি বছর ২১-২২ মিলিয়ন টন কয়লার প্রয়োজন। দীঘিপাড়া কয়লাক্ষেত্র থেকে প্রতি বছর তিন মিলিয়ন টন কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব হবে। 

দীঘিপাড়া খনি থেকে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হলে পাশাপাশি দুটি জেলার শিল্প-কারখানাগুলোও চালু রাখা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81