21970

05/12/2025

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে নিয়োগ বানিজ্যের সিন্ডিকেট

বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2023-06-08 04:33:45

জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা এবং সে লক্ষে ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রসমূহ পরিচালনা করতেই মূলত গঠন করা হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। এর বাইরেও অসংখ্য কাজ রয়েছে এ কর্তৃপক্ষের।

বস্তুত তা জানা থাকলেও কার্যত হচ্ছে তার উল্টো। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর এখন অনিয়ম-দুর্নীতিতে অভিযুক্ত লুটতরাজদের আঁতুড় ঘর বলেও দাবি করছে অধিদপ্তরটির একাধিক সূত্র।

নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি, টেন্ডার, কেনাকাটা; কোথায় নেই অনিয়ম ও দুর্নীতি। কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন এবং কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট মিলে নিয়োগ বানিজ্যের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে। নিয়োগ বানিজ্যের ডালপালা এখন দেশব্যাপী বিস্তৃত। 

প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশ থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদনকৃত প্রার্থীদের নিকট হতে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেয়ার নাম করে ৩-৫ লক্ষ ও ভাইভা সহ প্যাকেজ বাবদ ১৫-২০ লক্ষ করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

সূত্র মতে, অধিদপ্তরের মূল ভবনের সামনে একজন চা বিক্রেতার ৩/৪ টি স্টল রয়েছে। এই দোকানীও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। 'নিরাপত্তা প্রহরী' পদে উত্তীর্ণ প্রার্থী প্রভাবশালী সিবিএ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের 'পরিবার কল্যান পরিদর্শিকা' পদে প্রশিক্ষনার্থী ৬ জন প্রার্থীর কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেয়ার একটি লিখিত অভিযোগ দূর্নীতি দমন কমিশনে জমা পড়েছে। উক্ত অভিযোগ পত্রে ৬ জন প্রার্থীর রোল নম্বর সম্বলিত আবেদন রয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের একান্ত সহকারী এনামুল হক এবং প্রশাসন শাখার উচ্চমান সহকারী মোঃ আমিনুল্লাহর বিরুদ্ধে সর্বমোট ১ কোটি ২ লক্ষ টাকা ঘুষ গ্রহনের অভিযোগ রয়েছে। 

উক্ত লিখিত অভিযোগপত্র দাখিল করা প্রার্থীগণ হলেন, সোনিয়া সুলতানা; রোলঃ ৫১০০৫৪৭০৬, অদিতী বিশ্বাস; রোলঃ ৫১০০৫১৮১৫ (মৌখিক পরীক্ষাঃ ০১/০৬/২০২৩), সুমাইয়া পারভীন ইশা; রোলঃ ৫১০০৫৪৫৭৭ (মৌখিক পরীক্ষাঃ ১/৬/২০২৩, সকাল), খাদিজা খাতুন; রোলঃ ৫১০০৪৮৬৯০ (মৌখিক পরীক্ষাঃ ১/৫/২০২৩ বিকেল), বৃষ্টি খাতুন; রোলঃ ৫১০০৫২১৪ (মৌখিক পরীক্ষাঃ ১/৬/২০২৩ সকাল), ফাহমিদা খাতুন; রোলঃ ৫১০০৪৮৬২৬ (মৌখিক পরীক্ষাঃ ৩১/৬/২০২৩ বিকেল)। দুদকে এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ের অভিযোগ জমা পড়েছে। উক্ত আবেদনে এদের ছাড়াও আরো অসংখ্য প্রার্থীর কাছ থেকে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই ব্যাপারে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের একান্ত সহকারী এনামুল হকের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। 'দ্যা ফিন্যান্স টুডে'কে তিনি বলেন, আমি ছাড়া আমার পরিবারের কোন সদস্য পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে চাকরি করে না।

কিন্তু 'দ্যা ফিন্যান্স টুডে'র সূত্র ও অনুসন্ধান বলছে ভিন্ন কথা। এনামুল হকের বড় বোন নার্গিস সুলতানা শরীয়তপুরের কোদালপুর মা ও শিশু পরিবার কল্যান কেন্দ্রের 'পরিচ্ছন্নকর্মী' পদে কর্মরত। এছাড়াও তার আপন ছোটবোন ও ভাতিজী রাজধানী ঢাকার মিরপুরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মাজার রোড লালকুঠি মা ও শিশু হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়াও শরীয়তপুরের অসংখ্য ব্যক্তিকে টাকার বিনিময়ে চাকুরী দিয়েছেন। 

পারিবারিক জীবনে কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হওয়া এনামুল হকের বাবা কাঠমিস্ত্রী আঃ মান্নান ভুইয়ার সন্তানেরা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। গ্রামের বাড়ি বড় কালীনগর, নাগেরপাড়া, গোসাইরহাট; শরীয়তপুরে বর্তমানে বিশাল এক অট্রালিকা নির্মানাধীন। গ্রামের সাধারণ লোকজন হঠাৎ করে এই অট্রালিকা নির্মান দেখে হতভাগ। কারন আঃ মান্নান ভুইয়ার সন্তানেরা জীবন-জীবিকায় ৩য় ও ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারী। একমাত্র এনামুল হক দীর্ঘদিন যাবৎ পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে মহাপরিচালকের একান্ত সহকারী হিসেবে কর্মরত থাকার সুবাদে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

এই ব্যাপারে এনামুল হকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি 'দ্যা ফিন্যান্স টুডে'র অনুসন্ধানী টীমকে বলেন, "আমিও এসব অভিযোগের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। আমার বিরুদ্ধে আনীত এসকল অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। আমাকে বিতর্কিত করতেই এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে।" কিন্তু অনুসন্ধান বলছে অন্য কথা। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের সাথে সখ্যতা থাকার সুবাদে এনামুল হক গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। 

এছাড়াও কর্মচারী ইউনিয়নের কয়েকজন নামধারী নেতা বর্তমানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরা প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে পরিচয় দিলেও বাস্তবে মূলত বিএনপি-জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। 

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অধিকতর দুদক ও বিচারবিভাগীয় তদন্ত করলে দুর্নীতির এই মূল উৎপাটন করা সম্ভব।'

তাদের মতে, কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং নানাবিধ অনিয়মের কারণে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সুনাম ক্ষুন্ন হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স নীতি' এখানে ভোতা হয়ে গেছে। যা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়।

বর্তমানে এই সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরতে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব আজিজুর রহমান কঠোর অবস্থান গ্রহন করেছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অভিযোগ আমলে নিয়ে একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নজরদারি শুরু করেছেন। পাশাপাশি অধিদপ্তরের প্রভাবশালী কয়েকজনকে শাস্তিমূলক বদলী  করেছেন। একই সংগে কারো কারো বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

এর ফলে উক্ত দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের সদস্যরা চরম ভীতিতে দিন কাটাচ্ছে। অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মধ্যে বর্তমানে বিরাজ করছে বদলী আতংক। এমনকি অনেকে চাকুরী হারানোর শংকায় দিন কাটাচ্ছেন। বর্তমান সচিবের এই কঠোরতা চলমান থাকলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব বলে একাধিক সূত্র এফটি টীমকে নিশ্চিত করেছে।

নিয়োগ বানিজ্যের এই সিন্ডিকেটের সদস্য কাজী মাহাবুব হাসান, অটো সাইদুর, অর্থ বিভাগের আজিজ এবং উন্নয়ন বাজেট বরাদ্ধের মাযহারুল ইসলাম নিয়োগ বানিজ্যের পাশাপাশি সারা দেশ থেকে বিকাশের মাধ্যমে বাজেট বরাদ্দ এবং উন্নয়ন বরাদ্দের টাকা সুকৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তুলেছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কারো কারো রয়েছে একাধিক ব্যবসা বানিজ্য। এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমানসহ বিস্তারিত ধারাবাহিক প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হবে।

উল্লেখ্য, রাজধানীর কলেজগেটে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বিপরীতে একটি মসজিদ আছে। এই মসজিদের পাশে যে ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে সেটি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বাজেট বরাদ্দ বিভাগের মাযহারুল ইসলামের বলে একাধিক সূত্র 'দ্যা ফিন্যান্স টুডে'কে নিশ্চিত করেছে।

এছাড়াও লজিস্টিক শাখায় প্রায় ২০ লাখ ইনজেকশন, কোটি কোটি টাকার ঔষধ, জন্ম৷ নিয়ন্ত্রণ বড়ি এবং ইনজেকশন মেয়াদোত্তীর্ণ হতে চলেছে। এনিয়ে থাকবে বিস্তারিত পরবর্তী প্রতিবেদনে।


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81