10/13/2024
সালাহউদ্দিন মিঠু | Published: 2024-08-13 15:55:22
বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় বেশ কয়েকদিন যাবৎ যে শূন্যতা, সেটির অবসান হলো ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে। তবে শুরু থেকেই নতুন এই সরকারকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে বেশ কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতন হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সামনের দিনগুলো সহজ হবে না। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। দ্রব্যমূল্যের চাপে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। এটি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত রেখে লেখাপড়ার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ এখন সবার প্রত্যাশা। দেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এসব অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এমন সময়ে দায়িত্ব নিচ্ছে যখন দেশে ভেঙ্গে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রশাসন, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সেক্টরে আর সঙ্গে আছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিপুল প্রত্যাশা কিন্তু সবমিলিয়ে নতুন সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা দেশে তথা বর্হিবিশ্বে টিকতে পারেবে কি এই চ্যালেঞ্জ গুলো সংস্কার করে এটাই এখন ভাবনার বিষয়।
অন্তর্বর্তী সরকার বেসামরিক নেতৃত্বাধীন হতে চলেছে, তবে সেনাবাহিনীর হাতে কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে তা স্পষ্ট নয়। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বের প্রধান ভূমিকা থাকবে, এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে তারা নেতৃত্ব না দিলেও। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত হলেও সরকারের শেষ সময়ে এসে সামরিক বাহিনীর অবস্থান সরকারের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। বিক্ষোভ দমনে বলপ্রয়োগের ব্যাপারে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে একমত হয়নি সেনাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্যের অবসান শেখ হাসিনার পতন ঘটায়।’কুগেলম্যান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হলে সেটি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণকে পাকাপোক্ত করতে পারে বলে বাংলাদেশে অনেকে আশঙ্কা করেন। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী রাজনীতির ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে না যেমনটা কয়েক দশক আগেও ঘটেছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রাজপথ আগলে ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছাত্র আন্দোলনকে গণমানুষের আন্দোলনে রূপ দিয়েছে এই তরুণ শিক্ষার্থীরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে গাছ লাগানো, আবর্জনা পরিষ্কার করে পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশ গড়ার বার্তা দিচ্ছেন এ শিক্ষার্থীরা। এ শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে জোর দিচ্ছেন শিক্ষাবিদরা। ‘অনেক রক্তক্ষয় ও প্রাণ ক্ষয়ের পরে দেশে একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে। ড. ইউনূসের মতো নোবেলজয়ী বিশ্বের সম্মানিত ব্যক্তির নেতৃত্বে তরুণ-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত এ নতুন সরকার দেশটাকে সুন্দর করে গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। বিগত দিনে যেসব ভুলভ্রান্তি হয়েছে, সেগুলো শুধরে রাষ্ট্র কাঠামোয় সংস্কার এনে মানুষকে একটা বৈষম্যহীন সুন্দর জীবন উপহার দেবে তারা।’
সরকার পতনের পর ঢাকার প্রায় সব থানা থেকে সরে যায় পুলিশ সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় থানায় হয় হামলা।
মূলত আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে হতাহতের ঘটনা, গ্রেফতার এবং নির্যাতনের অভিযোগ জানিয়ে বহু মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আবার থানায় উত্তেজিত জনতার হামলায় পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনাও আছে।
সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট এখন প্রকট।বিভিন্ন স্থানে ঘটছে ডাকাতি, লুটপাট, ভাঙচুর।এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনাই নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ |
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে জনজীবনে ক্ষোভ-অসন্তোষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই নিম্নমুখী। দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মূল্যস্ফীতি অসহনীয় অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় নতুন সরকারকে গণ আস্থা ধরে রাখতে হলে শুরুতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য কমানোর দিকে নজর দিতে হবে।
“পশ্চিম অনেক দেশই ছয় মাসের মধ্যেই ইনফ্লেশন দশ-বারো শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। আমাদের এখানেও সম্ভব। আমরা এতোদিন প্রয়াজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারিনি বলেই হয়নি। এখানে মুদ্রার হার বাজারভিত্তিক রাখতে হবে, টাকা ছাপিয়ে সরকারের ব্যয় মেটানো যাবে না, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দেয়া যাবে না। এগুলো যদি করতে পারে এবং বিদেশি সহায়তা পায় তাহলে অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে বাধ্য।”
“রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতন্ত্র, তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব বের করে আনতে হবে, নির্বাচন প্রক্রিয়ায়ও সংস্কার আনতে হবে। যাতে ২-৩ শতাংশের ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হয়ে সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারে। কোনো একটা দল যেন তার ইচ্ছায় সংবিধান পরিবর্তন করতে না পারে।”স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করারও পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেই। “এ মুহূর্তে যে প্রধান রাজনৈতিক দল, তারা হয়ত সরকারের ওপর এ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করবে। সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন কীভাবে পদত্যাগ করবে- সেটিই বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ এ নির্বাচন কমিশনকে এখন তারা চায় না।”বাংলাদেশে এর আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনার উপর গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের আগেই এসব বিষয়ে এখন সংস্কারের তাগাদা দিচ্ছেন অনেকেই।কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা নয় সকলকে ন্যায়বিচার দেয়াও এই সরকারের দায়িত্ব। হাসিনা সরকারের সময়ে বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম ইত্যাদি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে জায়গা থেকে উঠে এসে বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোসহ সকলকে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা সহজ কাজ হবে না। আন্দোলন ঘিরে ঘটে যাওয়া সব মর্মান্তিক ঘটনার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত ও যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার মতো দায়িত্ব নিতে হবে নতুন সরকারকে। এছাড়া রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ডেলে সাজানোর উপরেও জোর দেন বিশ্লেষকরা।
‘অন্তর্বর্তী সরকার শীঘ্রই দারুণভাবে কাজ শুরু করবে বলে আশা করছি এবং নতুন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি হবে। যেই ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকবে মানুষের এবং যে সরকার জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।’
গত জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনে জয়লাভ করে সেই নির্বাচনে বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিরোধীদল ছিল না।
‘বিক্ষোভ আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়ার কারণের একটি অংশ হল দেশটি ১৫ বছরে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের দীর্ঘ কাজ শুরু করতে হবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেই পথ থেকে সরে গিয়েছিল বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তী সরকার এখনও গঠিত না হওয়ায়, এটি কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে, কখন নির্বাচন হতে পারে এবং কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে তা এখনো নিশ্চিত নয়।’
শিক্ষার্থী এবং নাগরিক সমাজ যেসব রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে, সেগুলোর জন্য দরকার পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু এর মধ্যেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। ইতোমধ্যেই ঢাকায় মাঠে নেমে সমাবেশও করেছে বিএনপি। দলটি তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে বলেছে।
কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবেলায় তিন মাস যথেষ্ট নয় বলেই আলোচনা আছে।
“সরকার যদি তিন মাসের জন্য আসে, ছয় মাসের জন্য আসে তাহলে সংস্কারে হাত দিয়ে লাভ নেই। আমরা আরেকটা ডিক্টেটরশিপ (স্বৈরতন্ত্র) পেয়ে যাবো এবং আরেকটা পরিবারতন্ত্র আসবে। এখানে বড় পরিবর্তনের জন্য তিন থেকে ছয় বছর সময় লাগবে।”
তবে অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ হওয়ার বিপক্ষেও যুক্তি আছে। কারণ এই সরকার নির্বাচিত নয় এবং নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দলও নেই।
“এখানে ঢালাওভাবে দুই থেকে তিন বছর সময় নিয়ে সংস্কার করবো এরকম একটা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ কম। আবার তড়িঘড়ি করে রাজনৈতিক দলগুলো চায় বলেই নির্বাচন দিতে হবে সেটা করাও নতুন সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন, নিরপেক্ষভাবে তৈরি করতে যে সময় দরকার সেটাই নিতে হবে। দীর্ঘ সময় লাগলে সেটা দেশেও এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।”
সবমিলিয়ে সরকারের সামনে বেশ বড় বড় চ্যালেঞ্জই এখন সামনে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81