05/18/2025
নেহাল আহমেদ, রাজবাড়ী | Published: 2025-05-17 15:07:08
দীর্ঘদিন ধরে পানি সংকটে রাজবাড়ীবাসী। কৃষিকাজ, মৎস চাষ, সুপেয় পানির জন্য রাজবাড়ীতে দরকার পানি। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে এই জেলা সংলগ্ন নদীগুলো, খাল বিলের অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে।
এই অঞ্চলের পানি সংকটের জন্য রাজবাড়ী জেলার পাংশাতে একটি ব্যারেজ নির্মানের প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও ভারতের বিরোধিতার কারনে এই প্রকল্প থেকে সরে আসে বিগত সরকার। এই প্রকল্প চালু হলে গঙ্গা ব্যারেজ’ সুবিধা ভোগ করবে দেশের ৩৭ শতাংশ এলাকা ও সেখানকার মানুষ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ হেক্টর একর জমি এক ফসলি থেকে তিন ফসলিতে পরিণত হবে। লবণাক্ততা দূর হবে। নদী তার স্রোত ফিরে পাবে। উদ্ধার হবে হারানো নৌ-পথ। সেচের আওতা বাড়বে। সুন্দরবনের প্রাণ ও প্রকৃতি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৪০০ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে একই পয়েন্টে পানির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র নয় হাজার ৬৯৮ কিউসেক।
প্রস্তাবিত প্রকল্পে বলা হয়েছিলো গঙ্গা ব্যারাজের মাধ্যমে ১৬৫ কিলোমিটার লম্বা একটি জলাধার তৈরি করা হওয়ার কথা; যেখানে ২.৯ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধরবে। আর মূল গঙ্গা ব্যারাজের দৈর্ঘ্য হবে ২.১ কিলোমিটার। এটি তৈরি করতে সাত বছর লাগবে। এই প্রকল্পের সমীক্ষা ও বিস্তারিত ডিজাইন তৈরির কাজ শুরু হয়েছিলো ২০০৯ সালে, যা শেষ হয়েছিলো ২০১৪ সালে। ভারতের আপত্তির কারনে যেটা বন্ধ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্পের বিনিয়োগের টাকা ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে উঠে আসবে। তবে এটা এমন নয় যে চার বিলিয়ন ডলার ৬ বছর পর বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে জমা হবে। তবে সার্বিকভাবে টাকাটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে এবং জিডিপিতে এর প্রভাব হবে দুই পয়েন্ট।
১৯৬৩ সালে, নিউ ইয়র্কের একটি পরামর্শদাতা সংস্থা টিপেটস-অ্যাবেট-ম্যাকার্থি-স্ট্র্যাটন পাকিস্তান সরকারকে বর্ষাকালে পানি ধরে রাখার জন্য এবং ক্ষীণ মৌসুমে গোরাই এবং অন্যান্য নদীতে সরবরাহের জন্য একটি পাল্টা বাঁধ নির্মাণের প্রস্তাব দেয়। ১৯৬৩ সালে আমেরিকার এক বিশেষজ্ঞ দল ফারাক্কা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাব থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা পেতে গঙ্গা ব্যারাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে। সে সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চলের জন্য জনগণের কল্যাণে এত টাকা ব্যয় করবে– তা বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, স্বাধীন দেশের ক্ষমতাবানরাও এই ব্যারাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবার সময় ৫৩ বছরেও পেল না।বাংলাদেশ রাজবাড়ী জেলার পাংশায় প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণ ‘আত্মঘাতী হবে’ এই অজুহাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনা এই প্রকল্প বাতিল করে দেয়।
২০০৫ সালে কাজ শুরুর পর ২০১৩ সালে সমীক্ষার কাজ শেষ হয়। পরের বছর ভারতকে ওই প্রকল্পের সারসংক্ষেপও হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সেই নকশা ‘পছন্দ হয়নি’ বলে তখনকান প্রধানমন্ত্রী বাতিল করে দেন। পাংশায় একটি বাঁধের সুবিধার মধ্যে প্রায় ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং ২,৫০,০০০ মেট্রিক টন মাছ ধরার সম্ভাবনা ছিল বলে অনুমান করা হয়েছিল।
তখনকার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, গঙ্গা ব্যারেজ নামে যে ব্যারেজের সমীক্ষা ও ডিজাইন তৈরি করেছে সেটা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। এটা আমরা নাকচ করে দিয়েছিলাম। পাংশায় নদীর মূল স্রোতের মধ্যে একখানা ব্যারেজ দিয়ে, তারপর পানি পানি করে কাঁদতে হবে আমাদের। এটা আমরা করতে রাজি না।”
জনগনেরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মূলত তারা ভারতের স্বার্থ রক্ষা করেছিলো বলে অনেকেই মনে করেন। মূলত ভারতের বিরোধীতার কারনে এই অজুহাত তুলে জনগনকে বিভ্রান্ত করা হয় বলে ধারনা করা হয়।
যৌথ নদী গঙ্গার অববাহিকার পানি সংরক্ষণের জন্য ১৯৬২-৬৩ সালে প্রথমবারের মতো গঙ্গা ব্যারেজ নির্মাণের বিষয়ে জরিপ হয়। এরপর ২০০৫ সালে ওই ব্যারেজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কাজ শুরু হয়। ২০১১ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য বলে বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা মত দেন। ভারতকে ওই প্রকল্পের সারসংক্ষেপও হস্তান্তর করা হয়।
সে বছর অক্টোবর মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ভ্রমণ করে ব্যারেজের ডিজাইনসহ বিস্তারিত কারিগরি দিক নিয়ে আলোচনা করে গেছেন। কিন্তু এরপর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আর কিছুই জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, সুন্দরবন এবং ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কিছু নদীতে পানির প্রবাহ বাড়বে।
উল্লেখ্য, যৌথ-নদী গঙ্গার ভাটিতে বাংলাদেশ অবস্থিত। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের উজানে পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা পয়েন্টে ফারাক্কা ব্যারেজ চালু করা হয়। এরপর ভাটিতে গঙ্গা নদীর পানি ঘাটতি দেখা দেয়।
সরকারি তথ্য অনুসারে, ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পানির পরিমাণ ছিল ৫০ হাজার ৪০০ কিউসেক। ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে একই পয়েন্টে পানির পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র নয় হাজার ৬৯৮ কিউসেক। সে সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে অববাহিকাভিত্তিক যৌথ পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি জোর পায় এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হয় বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়।
পতিত প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “ভারতের সঙ্গে যখন গঙ্গার পানি চুক্তি করি, তখনই আমি বলেছিলাম, আমরা একটা ব্যারেজ করব, গঙ্গা ব্যারেজ। সেই ব্যারেজটা হবে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে এবং যৌথভাবে। এমনভাবে এটা তৈরি করা হবে যেন দুটি দেশের মানুষ এটা ব্যবহার করতে পারে।”
তিনি বলেছিলেন “আমাদের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যেটা পাংশায় করেছে, সেটা সম্পূর্ণ ভুল একটা পরিকল্পনা। ওটা কখনো বাস্তবায়ন করা ঠিক হবে না।”
সে সময় মমতার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে পতিত সরকার ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “আমি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছি, আপনি জায়গা দেখেন, আমরাও দেখি। দুই দেশ মিলে ব্যারেজ বা ওয়াটার রিজার্ভার তৈরি করা উচিত। যেন বর্ষাকালে পানিটা ধারণ করে শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশের মানুষই তা ব্যবহার করতে পারি।”
পাংশায় প্রস্তাবিত গঙ্গা ব্যারেজের ফাইলে নোট লিখে ফেরত দিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, “ব্যারেজ বা রিজার্ভার যাই হোক, তা ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে করতে হবে এবং খরচও যৌথভাবে হবে।”
গঙ্গা ব্যারেজ নিয়ে পতিত প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর বিশেষজ্ঞরা এই ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কিছু বলতে রাজি হননি। তবে নকশাকারীদের একজন কর্মকর্তা একটি সংস্থাকে জানিয়েছিলেন ২০২৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আর ব্যারেজ নির্মাণের কাজ এখন শুরু হলেও তা শেষ হতে সাত বছর লাগবে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81