11/22/2025
সামিউর রহমান লিপু | Published: 2025-11-22 20:37:08
সাব রেজিস্ট্রার অফিসে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বহুদিনের। পুরো দেশেই এসব অফিসে দলিল রেজিস্ট্রেশন, তল্লাশি, নকল উত্তোলনসহ যেকোনো কাজে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। এ যেন ওপেন সিক্রেট।
বছরের পর বছর ধরে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে চলা ঘুষ, দালালি, হয়রানি ও অসহায় জনগণের সঙ্গে বাণিজ্যের অভিযোগ নিয়মিতই উঠছে। এই বিভাগটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হলেও দুর্নীতি দমনে তেমন কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থান ও হুশিয়ারির পরও মাঠপর্যায়ে এই অনিয়ম থামছেই না।
দীর্ঘ সময়ের ফ্যাসিবাদের সুযোগে সাব রেজিস্ট্রার অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িয়ে পড়েছেন দুর্নীতিতে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হচ্ছে এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা চিত্র৷ সাব রেজিস্ট্রার অফিসের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হলেও অনেকেই এখনও থেকে গেছেন পর্দার আড়ালে। কোন এক অজানা ক্ষমতার দাপটে ধামাচাপা পড়ে আছে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি।
বছরের পর বছর ধরে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে চলা ঘুষ, দালালি, হয়রানি ও অসহায় জনগণের সঙ্গে বাণিজ্যের অভিযোগ নিয়মিতই উঠছে। এই বিভাগটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হলেও দুর্নীতি দমনে তেমন কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বর্তমান সরকারের কঠোর অবস্থান ও হুশিয়ারির পরও মাঠপর্যায়ে এই অনিয়ম থামছেই না।
এবার সমাজের জন্য বিষফোঁড়া এসব দুর্নীতির তথ্য উন্মোচনে এগিয়ে এসেছে 'দি ফিন্যান্স টুডে'। আজকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসে চলা দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য।
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসে কর্মরত পেশকার শেখ বিল্লালকে ঘিরে উঠে এসেছে বিস্ময়কর সব অভিযোগ। এই উপজেলায় জমিজমা ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কাজে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে গিয়ে অপ্রত্যাশিত দুর্নীতির কবলে পড়েননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া বিরল।
নিয়মানুযায়ী, সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ প্রবেশ বয়স ৩২ হলেও শেখ বিল্লাল চাকরিতে যোগ দেন ৪৫ বছর বয়সে। গ্রেড–১৬ এর পেশকার পদে তার সরকারি বেতন কাঠামো ৯,৩০০ থেকে ২২,৪৯০ টাকা। অথচ তার গ্রামের বাড়িতে রয়েছে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ডুপ্লেক্স বাড়ি। নামে–বেনামে রয়েছে জমিজমাও।
অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, শেখ বিল্লালের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের বিলমামুদপুর নতুনডাঙ্গি এলাকায়। তার বাবার নাম শেখ আরসাদ। তার তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে শেখ ইউনুস (মৃত), মেঝো ছেলে শেখ বিল্লাল ও ছোট ছেলে শেখ দেলোয়ার। শেখ বিল্লালের দুই ছেলে আছে। বড় ছেলের নাম সাইফুল ও ছোট ছেলের নাম সাকিব। বড় ছেলে সাইফুল বাবার মতোই ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলাফেলা করেন। ব্যবহার করেন দামী গাড়ি, দামী পোশাক ও দামী ফোন।
স্থানীয়রা জানান, শেখ বিল্লাল বিলমামুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ময়েজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপর আর্থিক সংকটে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি সাব রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে অফিস পিয়ন পদে চাকরি নেন। কিছুদিনের মধ্যেই পদোন্নতি পেয়ে হন পেশকার। স্থানীয়দের ভাষায়—“পেশকার মানেই আলাউদ্দিনের চেরাগ।”
তারা আরও বলেন, শেখ বিল্লালের বড় ছেলে সাইফুল খুবই ভয়ংকর প্রকৃতির লোক। সাইফুল প্রায়শই এলাকায় এক ধরনের ত্রাস সৃষ্টি করে রাখে সব সময়। তার বাবার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতে গেলেই সাইফুল তাদের উপর চড়াও হয়, হুমকিধামকি দেয়।
স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শেখ বিল্লাল এর বাড়িতে ৪-৫ বছর আগেও চুলা জ্বলতো না। কিন্তু শেষ বয়সে এসে জনৈক আওয়ামী লীগ নেতার সুবাদে সরকারি চাকরি পেয়ে রীতিমতো ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন এই বিল্লাল।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর মোবারক খলিফার দাপটে পুরো এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়াতেন শেখ বিল্লাল। মোবারক খলিফা বর্তমানে পলাতক থাকলেও দাপট একটুও কমেনি শেখ বিল্লালের।
শেখ বিল্লালের বিরুদ্ধে ফরিদপুর দুদক কার্যালয়ে নাহিয়ান ইমন নামে এক ভুক্তভোগী লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। অভিযোগে বলা হয়—দলিল রেজিস্ট্রেশন, তল্লাশি, নকল উত্তোলন—যে কাজই হোক, সরকারি ফি ছাড়া অতিরিক্ত টাকা না দিলে কোনো ফাইল নড়াচড়া করে না। টাকা দিলে কাজ হয় মিনিট–ঘণ্টায়, না দিলে ঘুরতে হয় দিনের পর দিন।
আলফাডাঙ্গা সাব রেজিস্ট্রার অফিসে গেলে গ্রাহকদের মুখেই শোনা যায় একই অভিযোগ। অনেকে বলেন, “৪% ঘুষ না দিলে জমির দলিল হয় না। সব নিয়ন্ত্রণ করেন পেশকার শেখ বিল্লাল।”
দলিল লেখকরাও জানান, অফিসে কাজ করতে হলে বিল্লালের অনুমতি লাগে। কেউ তার নিয়মের বাইরে যেতে পারে না। টাকা দিলে রাতেও কাজ হয়, না দিলে ফাইল থেমে থাকে।
শেখ বিল্লালের গ্রামের বাড়িতে তৈরি করা আলিশান ভবনের নাম—‘কোহিনুর মঞ্জিল’। লোকজনের দাবি, বাড়িটি নির্মাণে খরচ হয়েছে তিন কোটি টাকারও বেশি। শুধু নিজের ছয় কাঠা জমিতে নয়, সরকারি দুই কাঠা জমি জবরদখল করেও বাড়িটি তৈরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শেখ বিল্লাল একটি ব্যাংক থেকে ৮৪ লাখ টাকা লোন নিয়ে গ্রামে এই বাড়ি করেছেন বলে স্থানীয়দের জানান। কিন্তু ২৫ হাজার টাকার বেতনে এত বড় লোন কীভাবে পাওয়া সম্ভব তা এখন রীতিমতো গবেষণারই বিষয়।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সাবেক আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর মোবারক খলিফার প্রভাব খাটিয়ে শেখ বিল্লাল দীর্ঘদিন ধরে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তিনিই নন, তার পরিবারও এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। অনেকে বলেন, “বিল্লাল কাউকে মানুষই মনে করতেন না। তার দুই সন্তানও হয়ে উঠেছে বেপরোয়া।”
শেখ বিল্লাল একটি ব্যাংক থেকে ৮৪ লাখ টাকা লোন নিয়ে গ্রামে বাড়ি করেছেন বলে স্থানীয়দের জানান। কিন্তু ২৫ হাজার টাকার বেতনে এত বড় লোন কীভাবে পাওয়া সম্ভব তা এখন গবেষণারই বিষয়।
সম্প্রতি ঘুষ, দুর্নীতি ও নানা অনিয়মের বিষয়ে তার বিরুদ্ধে একাধিক গনমাধ্যমের সাংবাদিকরা সরেজমিন অনুসন্ধানে গেলে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “নিউজ–টিউজ হলে আমার কিছু যায় আসে না। সাময়িক একটু ঝামেলা হবে, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।” অভিযোগ রয়েছে, কিছু সাংবাদিককে মাসিক মাসোহারা দিয়েও নিজের প্রভাব বজায় রেখেছেন তিনি।
জনগণের অভিযোগ, আলফাডাঙ্গা উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসে ধাপে ধাপে অনিয়ম এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে সাধারণ মানুষ দলিল করতে গেলে আতঙ্কে থাকে। অনেকেই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কাজ করাতে রাজি হন।
তাই স্থানীয়দের দাবি, শেখ বিল্লালসহ এই ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। নইলে সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দুর্নীতি আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে আলফাডাঙ্গা উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসের সাব রেজিস্ট্রার তনু রায়, ফরিদপুর সদর সাব রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও কেউ ফোন ধরেননি।৷
ফরিদপুর জেলার সকল উপজেলা সাব রেজিস্ট্রি অফিসে চলমান নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য 'দি ফিন্যান্স টুডে'র আগামী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হবে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81