12/12/2025
নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক | Published: 2025-12-12 13:16:50
মুক্তিযুদ্ধের সময় সারাদেশে ডাক্তারদের একটি গুরুত্বপুর্ন ভুমিকা ছিলো। সরাসরি যুদ্ধ হয়তো অনেকেই করেননি কিন্ত যারা যুদ্ধ করেছেন, আহত হয়েছেন তাদের চিকিৎসা দেবার জন্য দেশের অনেক স্থানেই গড়ে উঠেছিলো মেডিকেল ক্যাম্প।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আহতদের জটিল ও সমন্বিত চিকিৎসাগুলো দেওয়া হতো মূলত ভারতীয় কোনো হাসপাতালে। জরুরী প্রয়োজনে দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা এই অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো সেই গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেছিলো। মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানোর সঙ্গে যোগ হয় শত শত মানুষের গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনাও, যাঁদের হাসপাতালে নিয়ে সেবা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। তখন এগিয়ে এসেছিলেন পল্লী চিকিৎসক, কম্পাউন্ডার বা খুব সাধারণ মানুষ। এমন অসংখ্য সহমর্মিতার গল্পই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা।
যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার জন্য রাজবাড়ীতেও ছিল একটি মেডিকেল ক্যাম্প। প্রায় তিন মাস এই ক্যাম্পে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে এই ক্যাম্পটির কথা এখনো অজানাই রয়ে গেছে অনেকের কাছে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে ক্যাম্পটি সংরক্ষণ করা হোক।
রাজবাড়ী জেলায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মেডিক্যাল ক্যাম্পের দায়িত্ব নেন ডা গোলাম মোস্তফা। তার ভুমিকা ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস’ এক অমূল্য দলিল। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের বহু স্তরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা, গবেষণা চলছে। সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকালীন চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা।
জানা যায়, রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের বেথুলিয়া গ্রামে ১৯৪৭ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের সময় বিদ্যালয়টি একটি টিনের চারচালা ঘর ছিল। সেই সময়ে যা অস্থায়ী চিকিৎসা ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পরে ঘরটি আধাপাকা করা হয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত ভবনটিতে পাঠদান করা হতো। বর্তমানে নতুন ভবনে বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম স্থানান্তর হওয়ায় ভবনটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে।
যুদ্ধের ৫২ বছর হয়ে গেলেও অদ্যাবধি এসব ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়নি। শ্রদ্ধা জানানো হয়নি জীবনের মায়া ত্যাগ করে যারা সেবা দিয়েছেন সেই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রতিষ্ঠান অযত্নে অসচেতনায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেথুলিয়া গ্রামে অবস্থিত ৪০ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই হাতের বাম পাশে একটি টিনশেড পাকা ভবন। ভবনটির একটি বারান্দা রয়েছে। চালের টিনগুলো মরিচা ধরে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে।
রাজবাড়ীর যুদ্ধকালীন আহত কমান্ডার বাকাউল আবুল হাসেম এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তখন অনেক জায়গায় যুদ্ধ হচ্ছে। আমি যুদ্ধকালীন কমান্ডার হিসেবে আমার সঙ্গীদের নিরাপক্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। সিদ্বান্ত নেই রামকান্তপুরে আমার ক্যাম্পের পাশে একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প স্থাপন করবো। সিদ্বান্ত মোতাবেক তৎকালীন সিভিল সার্জন হুমায়ন কবির এবং ডাঃ গোলাম মোন্তফা এগিয়ে আসলেন। হাসপাতালে সেবা দেয়া দুরুহ হওয়ার কারনে প্রায় লোক চক্ষুর আড়ালে মাটিপাড়া স্কুলের একটি ঘরে মেডিক্যাল ক্যাম্পটি স্থাপন করা হয়। ডাক্তার হিসাবে গোলাম মোস্তফা দায়িত্ব নিয়ে প্রতিদিন আহত মুক্তি যোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতে থাকেন। ডাঃ মোস্তফা সবচেয়ে বড় অপারেশনটা করেন ইলিয়াস আলীর। তার মাথার মধ্যে গুলি লেগেছিল। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় এখানেই চিকিৎসা করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানীতে নেয়া হয়।
রাজবাড়ী জেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের মাটি পাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত একমাত্র মেডিকেল ক্যাম্পটি স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে বলে অনেকেই মতামত দিয়েছেন। এই হাসপাতালটি এখন বেথুলিয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসাবে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে।
প্রদক্ষদর্শী হোসেন মৃধার এখন বয়স ৭৮। স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই বেথুলিয়া গ্রাম তখন ঝোপ ঝাঁড়ে ভরা ছিলো। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে বিহারীদের আনোগোনা ছিলো। কোন মুক্তিযোদ্ধা ভয়ে সেখানে যেতে পারতো না। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হতো গোপনে। বেথুলিয়ার স্কুলটিতে সেবা দেয়া হতো। আমার বয়স তখন ২৫ বছর। আমরা গ্রামের অনেক মানুষ ডাক্তারদের সাহায্য করতাম। প্রতিদিন কেউ না কেই আহত হয়ে এই হাসপাতালে আসতো।
তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর এই ক্যাম্পের কথা আর তেমন স্মরণে রাখা হয়নি। কয়েক বছর আগেও এটিকে স্কুলের ক্লাসরুম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। টিনশেডের এই ভবনটি এখন পড়ে আছে। নতুন প্রজন্মের বেশিরভাগ মানুষই জানে না এই ক্যাম্পের কথা। বর্তমান সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে এই ক্যাম্পটিকে সংরক্ষণের দাবি জানাই।’
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আবদুস সোবাহান বলেন, ‘আমি এই স্কুলের শিক্ষক ছিলাম। এই সেবা দেওয়া হাসপাতালটি এখন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। স্মৃতি-জড়িত এই মেডিকেল ক্যাম্পটি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ করা যেতে পারে।’
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81