29668

10/04/2025

তথ্যের স্তূপ বনাম জ্ঞান

নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক | Published: 2025-10-03 16:04:07

শিক্ষার্থীদের একটা কমন সমস্যা হলো তারা জ্ঞান সংগ্রহ করছে নাকি মস্তিষ্ককে আবর্জনা দিয়ে পূর্ণ করছে এটা বুঝতে পারে না। শিক্ষকদের দায়িত্ব সেটা নির্ণয় করে দেয়ার কথা থাকলে তাদের সে বোধ শক্তি নেই। শিক্ষাকে তারা পেশা হিসাবে নিয়েছে অথচ এটা তাদের ব্রত হিসাবে নেয়ার কথা ছিলো।

তথ্যের স্তূপ বনাম জ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য আজকের পৃথিবী হলো এক অনন্ত সাগর—যেখানে চারদিক থেকে তথ্যের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। বই, শিক্ষক, ইউটিউব, গুগল, সোশ্যাল মিডিয়া—প্রতিটি জায়গা থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ করছে। কিন্তু একটি মৌলিক প্রশ্ন তারা খুব কমই নিজেদের কাছে করে: আমি কি সত্যিই জ্ঞান অর্জন করছি, নাকি কেবল মাথাকে তথ্যের আবর্জনায় ভরাট করছি? তারা কি বুঝতে পারে তথ্য আর জ্ঞানের পার্থক্য?

তথ্য হলো সংখ্যা, তারিখ, নাম, সংজ্ঞা, তত্ত্ব—যা মনে রাখা যায়, মুখস্থ করা যায়। কিন্তু জ্ঞান হলো তথ্যের বোধ, অভিজ্ঞতার সাথে তার মিল, এবং জীবনে প্রয়োগ করার ক্ষমতা। যেমন—ইতিহাসের একটি তারিখ মুখস্থ করা তথ্য, কিন্তু সেই তারিখের ঘটনার পেছনের সামাজিক কারণ ও মানবতার শিক্ষা বুঝতে পারা জ্ঞান। শিক্ষার্থীরা প্রায়শই ভাবে যে যত বেশি তথ্য জমা করা যায়, তত বেশি তারা শিক্ষিত। কিন্তু তথ্য যদি অনুশীলন, অনুধাবন, বিশ্লেষণ, এবং প্রয়োগের মাধ্যমে বোধে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা মস্তিষ্কে অপ্রয়োজনীয় ভার হয়ে থেকে যায়। এই ভার ধীরে ধীরে সৃজনশীলতাকে স্তব্ধ করে দেয়।

এর পিছনে শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এখানেই আসে শিক্ষকের দায়িত্ব। শিক্ষক যদি কেবল বইয়ের অধ্যায় শেষ করাকে শিক্ষা মনে করেন, তবে তিনি আসলে তথ্য সরবরাহকারী মাত্র। শিক্ষকের আসল ভূমিকা হওয়া উচিত:শিক্ষার্থীকে শেখানো কোন তথ্য প্রয়োজনীয় আর কোনটা নয়। তাদের প্রশ্ন করার অভ্যাস গড়ে তোলা। প্রতিটি তথ্যকে বাস্তব জীবনের সাথে সংযুক্ত করে দেখানো। তথ্যকে ছেঁকে নিয়ে জ্ঞানের আলোতে রূপান্তর করার পথ নির্দেশ করা।

কিন্তু আজকের দিনে দেখা যায়, অনেক শিক্ষক নিজেরাও এই বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে শিক্ষার্থী শুধু পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখতে শেখে, কিন্তু জীবনের খাতায় উত্তর খুঁজে পায়না।

যখন শিক্ষার্থীর কাছে প্রতিদিনের পাঠ্য আর অনলাইন তথ্যগুলোর ভিড়ে কোনো ছাঁকনি থাকে না, তখন প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি লেকচার, প্রতিটি ভিডিও, প্রতিটি পোস্ট একেকটা অব্যবহৃত ফাইলের মতো মাথায় জমতে থাকে। এগুলো না মুছতে পারে, না ব্যবহার করতে পারে। একসময় এই ভরাট মাথা হয়ে ওঠে আবর্জনার স্তুপ। ফল কী হয়?চিন্তার স্বচ্ছতা নষ্ট হয়।
মনে হয় অনেক কিছু জানি, কিন্তু আসলে কাজে লাগাতে গেলে বোঝা যায় কিছুই জানা নেই।
সৃজনশীলতা ও কল্পনা শক্তি ধীরে ধীরে মরে যায়।

জ্ঞান কখনো মুখস্থ করা যায় না, জ্ঞানকে শুধু বোঝা যায় এবং অনুশীলন করা যায়। জ্ঞান হলো জীবনের আলো, যা পথ দেখায়, সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে, এবং মানুষকে পরিবর্তন করে।

তথ্যের স্তূপে ভরা এক শিক্ষার্থী হয়তো পরীক্ষায় ভালো করতে পারে, কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়। বিপরীতে, যার কাছে কম তথ্য আছে কিন্তু সে সেগুলোকে বোধে রূপান্তর করতে শিখেছে, সে-ই সত্যিকার অর্থে জ্ঞানের অধিকারী।

আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সংকট হলো তথ্যকে জ্ঞান বানানোর সেই বোধশক্তির অভাব। শিক্ষার্থী বুঝতে পারে না তার মাথা পূর্ণ হচ্ছে আলোয় নাকি আবর্জনায়। আর শিক্ষকরা যদি এই পার্থক্য বোঝাতে ব্যর্থ হন, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিণত হবে কেবল তথ্যের গুদামে।

সত্যিকারের শিক্ষা হলো—তথ্যকে ছেঁকে নেওয়া, অনুধাবন করা, এবং জীবনের সাথে যুক্ত করে জ্ঞানে রূপান্তর করা। যেদিন শিক্ষার্থী এই ক্ষমতা অর্জন করবে, সেদিন তার মস্তিষ্ক হবে আলোকিত উদ্যান, আবর্জনার স্তূপ নয়।


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81