29699

10/05/2025

চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসে বিল্লাল-ইয়াহিয়ার রমরমা ঘুষ বানিজ্য

গাজী গোফরান | Published: 2025-10-05 12:59:31

ভোগান্তি আর জনদুর্ভোগের আরেক নাম চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস। দীর্ঘ লাইন ও ভিড়ে নাকাল অবস্থা সেবা প্রত্যাশীদের। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রয়েছে হয়রানিসহ নানা অভিযোগ। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস এখন দালাল ও দুর্নীতির ছত্রচ্ছায়ায় পরিণত হয়েছে।

চট্টগ্রাম পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. বিল্লাল হোসেন ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিয়ন্ত্রণে এখানে গড়ে উঠেছে কোটি টাকার দালাল সাম্রাজ্য। ঘুষ ছাড়া যেন কোনো কাজই হয় না। সাধারণ আবেদনকারীকে নানা অজুহাতে হয়রানি করে বাধ্য করা হয় দালালের শরণাপন্ন হতে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য চলে প্রকাশ্যে, অথচ মাঝে মাঝে দুদক অভিযান চালালেও কোনো স্থায়ী পরিবর্তন আসে না।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের অনিয়ম–দুর্নীতি বন্ধে উপ-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পান মোহাম্মদ তাজ বিল্লাহ। তার সময়ে অফিস পুরোপুরি দুর্নীতিমুক্ত ছিল, পাসপোর্ট করতে জনসাধারণকে কোনো ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। পরবর্তীতে উপ-পরিচালক শরীফুল ইসলাম দায়িত্ব নিলেও স্বস্তি বজায় থাকে। তবে সহকারী পরিচালক হিসেবে শওকত মোল্লা যোগদানের পর আবারও দালালদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে। শওকত মোল্লাকে সরানোর পর দায়িত্ব নেন বর্তমান সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেন, যিনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগসাজশে পুরো অফিসকে দালালদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেন।

সরেজমিনে চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ঘুরে দেখা গেছে, দালাল ছাড়া এখানে কোনো আবেদনই গ্রহণ হয় না। শতকরা ৫ শতাংশ আবেদনও সরাসরি জমা নেওয়া হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে অধিকাংশ আবেদনকারী দালালের শরণাপন্ন হচ্ছেন।

প্রতিদিন গড়ে ৫০০–৬০০ জন আবেদনকারী পাসপোর্ট করতে আসেন। এর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশকেই দালালের মাধ্যমে আবেদন জমা দিতে হয়। প্রতিদিন প্রায় ৫–৬ লাখ টাকার ‘মার্কা বাণিজ্য’ হয়, যা মাস শেষে কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, দালালরা বিশেষ সংকেত ব্যবহার করে কাজকে সহজ বা কঠিন করে তোলে। সংকেত থাকলে আবেদন গ্রহণ সহজ হয়, না থাকলে নানা অজুহাতে ফরম বাতিল করে দেওয়া হয়।

আবেদন বাতিলের অজুহাতের মধ্যে রয়েছে—বিবাহিতদের নিকাহনামা চাওয়া, জাতীয় পরিচয়পত্রে সামান্য ঠিকানার অমিল দেখানো, ব্যাংক চালানে বাংলায় লেখা থাকলে বাতিল করা, ২০ বছরের নিচের আবেদনকারীর জন্য পিতামাতার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা এবং পেশার সামান্য অমিল দেখিয়ে আবেদন বাতিল করা ইত্যাদি।

চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে মাঝেমধ্যে দুদক অভিযান চালালেও কার্যকর কোনো ফল পাওয়া যায় না। গোপন সংকেত বুঝতে না পেরে দুদক কর্মকর্তারা দায় চাপিয়ে দেন আনসার বা পুলিশ সদস্যদের ওপর। কয়েকদিনের জন্য কার্যক্রম শিথিল হলেও অচিরেই আবার পুরনো নিয়মেই চলে সকল কার্যক্রম।

জানা যায়, অফিস প্রাঙ্গণ ও গেইটের বাইরে ২০–২৫ জনের একটি দালাল চক্র সক্রিয় থাকে। এদের মধ্যে মাত্র ৮–১০ জনের বিশেষ সংকেত ব্যবহারের ক্ষমতা আছে। সংকেতের জন্য আবেদনকারীদের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা নেওয়া হয়—এর মধ্যে ১,৬০০ টাকা অফিসে যায়, আর ৪০০ টাকা থাকে দালালের হাতে। এই টাকা নিয়মিত সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেনের কাছে পৌঁছায়। আবার, আনসার বা পুলিশের নাম ভাঙানো দালালরা ১,৫০০ টাকায় এক মিনিটেই আবেদন জমা করে দেন। দিন শেষে প্রতি ফাইল থেকে ১,০০০ টাকা অফিসে পৌঁছায়, বাকি টাকা তাদের ভাগে যায়।

অফিসের কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সহকারী পরিচালক ও সুপারিন্টেন্ডেন্টের চাপে তারা বাধ্য হয়ে এসব কাজ করেন। নির্দেশ অমান্য করলে বদলির হুমকি দেওয়া হয়।

কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, আবেদন জমা করতে না পেরে সহকারী পরিচালকের নিকট গেলে কোনো প্রকার সহযোগিতা পাওয়া যায় না। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কাউন্টারে আবেদন গ্রহণ না করলে তার কিছুই করার নেই।

হাটহাজারি থেকে আসা এক আবেদনকারী বলেন, 'আমার পাসপোর্ট জমা দিতে গিয়ে মূল জাতীয়তা সনদ না থাকায় আবেদন বাতিল করা হয়। পরে দালালকে ২ হাজার টাকা দিলে সঙ্গে সঙ্গে জমা হয়ে যায়।'

চন্দনাইশ থেকে আসা আরেকজন আবেদনকারী জানান, 'এনআইডিতে পেশা ছাত্র থাকলেও বর্তমানে আমি বেকার। বেকার উল্লেখ করায় আবেদন বাতিল করা হয়। পরে বাইরে এসে এক দালালকে ২ হাজার টাকা দেওয়ার ১৫ মিনিট পর আবেদন গৃহীত হয়।'

এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক শরীফুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত সেবাপ্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দালালদের মার্কা কিংবা বিশেষ সংকেত সম্পর্কে অবগত নই। পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় দালালদের নিয়মিত আটক করা হচ্ছে। এই বিষয়ে কারো সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে অভিযুক্ত সহকারী পরিচালক বিল্লাল হোসেন ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও এই বিষয়ে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81