29706

10/06/2025

দুর্নীতিবাজ মোহাম্মদ আলী ফের এমডি হতে চায় পূবালী ব্যাংকের

বিশেষ প্রতিবেদক | Published: 2025-10-06 19:01:18

দুর্নীতির পৃথক চারটি অভিযোগে অনুসন্ধান চলমান থাকার পরও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। ব্যাংকটির অধিকাংশ পরিচালকের আপত্তি উপেক্ষা করে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান তার দুর্নীতির সারথী মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় নিয়োগ দিতে তোড়জোড় শুরু করেছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অসাধু এক ডেপুটি গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের মোটা অংকের উৎকোচ দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মোহাম্মদ আলী পুন:নিয়োগ পেলে ব্যাংকটিতে মন্দ ঋণ ও খেলাপী ঋণের পরিমান বাড়বে। ইতোমধ্যে মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি সহ নানা অভিযোগে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে দুদক। এছাড়াও মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুরুর রহমানের জ্ঞাত আয় বর্হিভূত সম্পদ অর্জনের বিষয়েও শিগগিরই তদন্ত শুরু হবে বলে জানা গেছ।

দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জনৈক ফরহাদ হোসেন দুদকে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগে পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী, সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হাফিজ আহমেদ মজুমদার, তৎকালীন পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক এবং অন্য পরিচালক কবিরুজ্জামান ইয়াকুবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। দুদক অভিযোগটি আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে এবং ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হাফিজুর রহমানকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি অভিযোগ সশ্লিষ্টদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

দুদক থেকে পাওয়া অথ্য অনুযায়ী মোহাম্মদ আলী ও মঞ্জুরুর রহমানের নেতৃত্বে পূবালী ব্যাংকে একটি শক্তিশালী চক্র ব্যাপক অনিয়ম, নিয়োগবাণিজ্য, ডলার কারসাজি, সম্পত্তি বিক্রি, ঋণ বিতরণে অনিয়মসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত। বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় এবং বাণিজ্যের আড়ালে রহস্যজনক অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত ইতিপূর্বে ক্ষমতার দাপটে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পূবালী ব্যাংকের এই চক্রের অন্যতম হোতা ছিলেন প্রয়াত এইচটি ইমামের আত্মীয় সিরাজগঞ্জের মোহাম্মদ আলী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকটির এমডি ও সিইও পদে রয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সাইদুর রহমান ও এস কে সুরের সহযোগিতায় এই চক্র ব্যাংকটিকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করে। ২০২৩ সালে এই চক্র ডলার কারসাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কিনে ২১১ কোটি টাকা বেশি ব্যয় বা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, মঞ্জুরুর রহমান ও মোহাম্মদ আলী চক্র হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের এক্সচেঞ্জ করা শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলে না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দুদক সূত্র আরও জানায়, ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমান ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ২৫ লাখ গ্রাহকের আমানতের ১ হাজার ১৪১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পূবালী ব্যাংকের অন্যতম অংশীদার ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ারধারী হিসেবে মঞ্জুরুর রহমান পরিচালক ছিলেন। তিনি ডেল্টা লাইফে তার চার সন্তানকে পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন এবং কন্যা আদিবা রহমানকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে বসিয়েছেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তিনি পূবালী ব্যাংকেও লুটপাট অব্যাহত রেখেছেন। ডেল্টা লাইফের ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ডাটাবেজ সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে ফেলার অভিযোগও রয়েছে মঞ্জুরুর রহমানের বিরুদ্ধে।

এছাড়া, পূবালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধেও অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালে অনিয়মের দায়ে ১০ পরিচালককে সরানোর নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পরিচালক ফাহিম আহমেদ ফারুক চৌধুরী ও এম খাবিরুজ্জামান ইয়াকুবসহ কয়েকজন এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা বলে দুদকের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগে আরও বলা হয়, সাবেক এমপি হাফিজ আহমেদ মজুমদার বর্তমানে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান। তার আগে চেয়ারম্যান ছিলেন মঞ্জুরুর রহমান। তারা দুজনই প্রায় দেড় যুগ ধরে পূবালী ব্যাংক ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানের পদ দখল করে লুটপাট ও অর্থ আত্মসাৎ করছেন। তাকে দুদক দুই দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

সাদমুসা গ্রুপকে অনৈতিক সুবিধা

পূবালী ব্যাংক থেকে বিতর্কিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাদ মুসা গ্রুপকে শতকোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। পূবালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এম এ রহমান ডাইং পূবালী ব্যাংকের সিডিএ এভিনিউ শাখা থেকে ঋণ নেয়। প্রথম দিকে নিয়মিত ঋণ থাকলেও পরে অনিয়মিত ঋণে পরিণত হয়। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির খেলাপি পাওনার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭১ কোটি ৭৮ লাখ ২৫ লাখ ১৯৬ টাকা। বর্তমানে এই টাকার পরিমান চারশত কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

এছাড়াও সাদ মুসা গ্রুপ পূবালী ব্যাংক থেকে এলসি সুবিধাসহ বিভিন্নভাবে হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। দুদকের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে পৃথক একটি দল এই আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করছে। ইতোমধ্যে দুদকের টিম ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ আলী ও চেয়ারম্যান মনজরুর রহমানসহ সংশ্ষ্টিদের জিজ্ঞাসাদের জন্য তলবী নোটিশ দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সাদ মুসা গ্রুপের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় এমডি, চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক।

করিম গ্রুপের বিষয়ে তদন্ত

পূবালী ব্যাংকের ফরিদপুর অঞ্চলের একজন অংশীদারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী ফরিদপুর ভিত্তিক করিম গ্রুপকে প্রায় ১৮৪৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। যার পুরোটাই খেলাপী। এই ঋণ বিতরনে মোহাম্মদ আলী ও একজন পরিচালক ৫শতাংশ হারে ঘুষ নিয়েছেন বলে দুদকে জমা হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে। এই বিষয়ে কমিশন একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

করিম গ্রুপকে দেওয়া ঋণের মধ্যে ফান্ডেড ফ্যাসিলিটি ৬০৯ কোটি, নন ফান্ডেড ফ্যাসিলিটি ১২৩৪ কোটি টাকা। বর্তমানে ফোর্স লোন ১১০ কোটি টাকা সহ ব্যাংকের পাওনা ৫৮৬ কোটি ও সর্বমোট প্রায় ৯০০ কোটি টাকা যা আদৌ আদায়যোগ্য নয় বলে বলা হয়েছে।

এসব ঋণের বেশিরভাগ বিতরণ করা হয় ঢাকা স্টেডিয়াম শাখা থেকে। এই করিম গ্রুপকে ঋণ বিতরণে অভিউৎসাহী ও অগ্রনী ভূমিকা রাখেন ফরিদপুরের এক ব্যবসায়ী।

এই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জামানতও রাখা হয়নি। ইতোমধ্যে ঋণটি শ্রেণীভূক্ত বা ক্লাসিফাইড হয়ে গেছে। করিম গ্রুপকে ব্যাংকের শতশত কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে সহযোগিতা করেছেন পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজরুর রহমান ও এমডি মোহাম্মদ আলী। তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানপূর্বক বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।

আরও ঋণ জালিয়াতি

মোহাম্মদ আলী ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূবালী ব্যাংকের বাজার রোড শাখা, বরিশাল এর গ্রাহক মোহাম্মাদি ইলেকট্রিক ওয়্যার এন্ড মাল্টি প্রোডাক্টস ২,২২,৮৫৪.০০ মার্কিন ডলার, সিলেটের গ্রাহক মেসার্স হাসান ব্রাদার্স ১১০,৮৪২ মার্কিন ডলার মন্দ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। মতিঝিল কর্পোরেট শাখার গ্রাহক রিফাত গার্মেন্টস লি. (হিসাব নং-০৩৪০৯০১০৯৩৭৬০) এর হিসাবে কয়েকশ কোটি টাকার লেনদেন হয়। ক্রিয়েটিভ ফ্যাশনেও একই ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া আমিরানেট লিমিটেডকে এমডির সহায়তায় ৯০৫ কোটি টাকা লোন দেওয়া যায়েছে।

বন্দর স্টিলের মালিক পক্ষের ভিতরে অনেক আগে থেকেই ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা লোন সুবিধা দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী। হক বিস্কুট ফ্যাক্টরি, তামিম এগ্রো লিঃ, রানু এগ্রো, জহর এগ্রোসহ বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানে পরস্পর যোগসাজসে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। মোহাম্মদ আলীর নির্দেশে ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল রাজধানীর বংশাল শাখা থেকে। এছাড়া, পূবালী ব্যাংক রাজশাহী প্রধান শাখার মাধ্যমে বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপের দোসর নাবিল গ্রুপকে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা এলসি লিমিট দেওয়া হযেছে। ডাচ বাংলা ব্যাংকের পলাতক মালিক সাহাবুদ্দিনের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মতিঝিলস্থ ব্র‍্যাক ব্যাংক থেকে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করা হয়েছে যার পুরোটাই খেলাপী হয়ে পড়েছে। দুদক এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য শিগগিরই কমিটি গঠন করবে বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও সিইও মোহাম্মদ আলী অভিযোগের বিষয়ে ব্যাংকের জনসংযোগ শাখায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন


Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman

Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81