05/03/2025
নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক | Published: 2025-05-02 15:49:13
রাজবাড়ী জেলায় পাংশা রেলস্টেশন গেলে চোখে পড়বে একটি পুরোনো লালচে পানির ট্যাংক। বিশেষ কোনো গুরুত্ব না থাকলেও পরিত্যক্ত এই ট্যাংকটি প্রায় শতাব্দীর পর শতাব্দী আগের ইতিহাস হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। এত বছরেও এটির লাল রং ঝকঝক করছে। এমনকি একটি ইটও এখন পর্যন্ত খসে পড়েনি। এটি ১৮৬৯ সালে ব্রিটিশদের তৈরি রেলের জলঘর। সবুজ আগাছায় ছেয়ে থাকা লালচে এই ভবনের নাম জলঘর।
ইতিহাস থেকে জানা যায় ব্রিটিশ আমলে ১৮৬২ সালে প্রথম ভারতের কলকাতা থেকে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত যোগাযোগের জন্য রেলপথ নির্মাণ করা হয়। ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি দেশের বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার জগতি থেকে বর্তমানে রাজবাড়ীর (তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা) গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া (পদ্মা নদীর) ঘাট পর্যন্ত প্রায় ৮০ কিলোমিটার এক লাইনের রেলপথ বানানো হয়।
রাজবাড়ী রেল ষ্ট্রেশন তৈরি করা হয় ১৮৯০ সালে। ঐ সময়ে রেলগাড়ি টানার জন্য কয়লাচালিত ইঞ্জিন ব্যবহার করা হতো। কয়লাচালিত ইঞ্জিন প্রচণ্ড গরম হয়ে যেত। গরম ইঞ্জিন শীতল করার জন্য কুষ্টিয়ার জগতি ও দৌলতদিয়া ঘাট রেলস্টেশনের মাঝামাঝি পাংশা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে নির্মাণ করা হয় এই জলঘর।
১৮৬৯ সালে ইট, খোয়া ও চুনের সংমিশ্রণে গোলাকার ও লম্বা এ ভবন নির্মাণ করা হয়। ৩৫-৪০ ফুট উঁচু এই জলঘর। ঘরের দরজা রাখা হয় রেললাইনের দিকে। জলঘরের ওপরের দিকে ওঠা ও নিচে নামার জন্য লোহার পাত দিয়ে সিঁড়ি বানানো হয়। ব্রিটিশ শাসনামলে এই জলঘর ব্যবহার করা হতো।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান শাসনামল শুরু হওয়ার পরপরই জলঘরটি থেকে রেলগাড়ির ইঞ্জিনে পানি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত জলঘরের ব্যবহার বন্ধ রয়েছে। জলঘরটি কালের সাক্ষী হয়ে আছে পাংশার বুকে। এর লাল রং এখনো ঝকঝকে, দেয়ালের কোনো স্থান থেকেই এখন পর্যন্ত একটি ইট বা খোয়ার অংশবিশেষ খুলে পড়তে দেখা যায়নি।
সম্ভবত রাজবাড়ী জেলাই একমাত্র শহর যেখানে প্রতিটি থানায় রয়েছে রেল ষ্টেশন। পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় সব জেলার সাথেই রেলযোগে রয়েছে রাজবাড়ীর।
অতীতে প্রতিদিন রাজশাহী, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গাসহ বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ ট্রেনযোগে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত এসে তারপর লঞ্চ ও ফেরিতে করে পদ্মা পাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া ঘাটে পৌছাতেন। তারপর বাস ধরে মানিকগঞ্জ এবং ঢাকা জেলায় প্রবেশ করতেন।
রেলের উপর নির্ভর করে এখানে জন বসতি গড়ে উঠলে রাজবাড়ীকে রেলের শহর বলা হয়। এখানে পানির ট্রাং, পাওয়ার হাউজ রেলের হাসপাতাল, কলোনী, রেল ক্লাব সহ অফিসারদের থাকার জন্য বৃটিশ সরকারের সময় নির্মিত স্থাপনা রয়েছে। যে স্থাপনাগুলো দেশের ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসাবে চিহ্ন বহন করে। কয়লা ইঞ্জিনের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এই জলঘর।
রাজবাড়ী জেলার প্রথম রেল ষ্টেশনের অদূরে চোখে পড়বে পুরোনো লালচে পানির ট্যাংক। দেখতে সুউচ্চ দৈত্যের মতো দেখতে হলেও পুরোনো সেই পানির ট্যাংক এখন পরিত্যক্ত। সবুজ আগাছায় ছেয়ে আছে জলঘরটি।
জলাঘরে কি জল মিলবে? না। থাকার কথাও নয়। দীর্ঘ বছরের পুরোনো এই জলঘর বা ট্যাংক যে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে টিকে আছে, সেটাই-বা কম কি।রাজবাড়ী জেলায় শুধু এই জলঘর নয়, সংস্কৃতি হাব রাজবাড়ীতে আরো অনেক ওভারহেড ট্যাংক আছে যেগুলো একসময় বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য রাজবাড়ীবাসীর প্রধান উৎস ছিল। বিশেষ করে রেল কোয়ার্টারে যারা বসবাস করতেন তাদের জন্য। কয়েকটি সচল থাকলেও বেশীরভাগই কালের বিবর্তনে ওয়াসার ভূগর্ভস্থ পানির পাম্পের ভিড়ে এসব ট্যাংক ‘অসহায়ের মতো’ দাঁড়িয়ে আছে। নেই রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা সংরক্ষণের তাড়না। অথচ এসব ট্যাংকের প্রাচীর কাঠামো, স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণকৌশল এতই অসাধারণ এবং স্বতন্ত্র যা যে কারো নজর কেড়ে নিতে বাধ্য।
বৃটিশদের তৈরি করা এসব জলঘর নিয়ে আলোচনা করলেই চলে আসে পানি সরবরাহের ইতিহাস। যুগে যুগে অনেক ছিল বিশুদ্ধ পানির অভাব। সুবেদারী আমল থেকেই পানির উৎস ছিল নদী, পুকুর-ডোবা ও পাতকুয়া। এর ফলে কলেরা হয়ে যায় মানুষের নিত্যসঙ্গী। লোকসংগীত সংগ্রাহক দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেন, ‘কূপের জল খাইতে হইতো, তাহাতে গলগণ্ড হইতো এবং সেই জলের গুণে বারো মাস কলেরা লাগিয়া থাকিতো।’
এরপরই শুরু হলো ‘ভিস্তিওয়ালার’ যুগ। তারা বাড়ি গিয়ে পানি সরবরাহ করতো থলেতে করে। ছাগল বা ভেড়ার পাকা চামড়ার এই থলেকে বলা হতো ভিস্তি।
বর্তমানে রেলের এসব সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে, অনেক জায়গায় নজর নেই রেল কর্তৃপক্ষের। অথচ এই ট্যাংকগুলোকে একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে।
রাজবাড়ী জেলাবাসী যেমন অসচেতন তেমনি সরকারও উদাসীন রাজবাড়ীর ইতিহাস ও ঐহিত্য নিয়ে। কারো কোনো সুনজর আসেনি এই ব্রিটিশ আমলের ছোটো ছোটো বিষয়গুলোর প্রতি। রাজবাড়ীর বিখ্যাত স্থাপত্যগুলোই জেলার ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে পড়ে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরকে এগুলো রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
Editor & Publisher : Md. Motiur Rahman
Pritam-Zaman Tower, Level 03, Suite No: 401/A, 37/2 Bir Protik Gazi Dastagir Road, Purana Palton, Dhaka-1000
Cell : (+88) 01706 666 716, (+88) 01711 145 898, Phone: +88 02-41051180-81