June 15, 2025, 1:34 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-06-14 02:49:58 BdST

লন্ডনে তারেক-ইউনূস বৈঠকআশ্বাস নাকি নতুন অনিশ্চয়তা


লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যে সদ্য অনুষ্ঠিত বৈঠকটি নিঃসন্দেহে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দেশবাসীর মধ্যে অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ও আশ্বাস মিলেছে। এই বৈঠক ঘিরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝেও ছিল প্রবল আগ্রহ।

এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, এই আলোচনা যেন খানিকটা আশার আলো — আবার একই সঙ্গে নতুন দ্বিধার জন্মও দিয়েছে।

বৈঠক শেষে জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান জানিয়েছেন, তারেক রহমান রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছেন। উত্তরে ড. ইউনূস শর্তসাপেক্ষে জানিয়েছেন— যদি বিচার ও সংস্কার প্রক্রিয়া গুছিয়ে ফেলা যায়, তাহলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন সম্ভব। তবে এই ‘যদি’টিই এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

‘যদি’র বাস্তবতা

বিচার ও সংস্কার—এই দুই শব্দ এখন গোটা রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। বাস্তবতা হলো, এখন পর্যন্ত বিচারকার্য শেষ হয়নি, সংস্কার প্রক্রিয়াও কার্যকরভাবে শুরু হয়নি। অর্থাৎ ড. ইউনূসের মন্তব্যটি ছিল একরকম রাজনৈতিক কৌশল, যার ভেতরে আছে আশ্বাস, কিন্তু নেই প্রতিশ্রুতি। কোন সময়সীমাও সঠিকভাবে বাতিয়ে দেয়া হয়নি।

তবে তারেক রহমানের বিনয়ী আচরণ খুব প্রশংসিত হয়েছে সর্বমহলে। সোশ্যাল মিডিয়া সহ বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইনে এটিই ছিলো টক অব দ্য কান্ট্রি। সব কিছুর ঊর্ধ্বে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বিএনপি পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে— আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব, এই বৈঠক তার প্রমাণ। তারা ফেব্রুয়ারির সম্ভাব্য নির্বাচন নিয়ে খানিকটা আশাবাদী। অন্যদিকে, এনসিপি (NCP) প্রশ্ন তুলছে; বিএনপির ইচ্ছায় যদি সব কিছু নির্ধারিত হয়, তবে জাতীয় ঐক্য কিংবা ন্যায়ের প্রশ্ন কোথায়? তারা স্পষ্ট বলেছে, সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়ার আগে কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য নয়। তারা নিজেদের আখের গোছাতে তাদের জায়গায় অনড়।

এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি — সময়ের পরিবর্তন না সংকটের পুনঃপ্রবেশ?

এপ্রিলের নির্বাচনকাল নিয়ে পূর্বের যে আপত্তি ছিল বিএনপির, সেটির প্রেক্ষাপটেই ফেব্রুয়ারির প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু এনসিপি যদি তাদের আপত্তিতে অনড় থাকে এবং বিচার-সংস্কারের কাজ যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ না হয়, তাহলে এই নতুন সময়সীমাও হয়ে উঠতে পারে আরেকটি অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি।

এখানে মনে রাখতে হবে— ‘সময়ের পরিবর্তন’ রাজনীতিতে সব সময়ই একটি কৌশল। এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি নামমাত্র একটি পেছানো সময়সীমা হলেও এর মধ্যে কি সত্যিকারের সংলাপ, সমঝোতা, এবং কাঠামোগত প্রস্তুতি থাকবে? নাকি এটি হবে শুধুই একটি রাজনৈতিক কালক্ষেপণ?

সামনে কী?

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বলা যায়— উচ্চচাপে বদ্ধ একটি সিলিন্ডার, যার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। যদি সময়মতো সমঝোতা না হয়, তাহলে এই চাপ বিস্ফোরণে রূপ নিতে পারে। যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হাড়ে হাড়ে বুঝার চেষ্টা করছে। দেশের মানুষ কোনভাবেই আর সংঘাত চায়না। সাধারণ মানুষ চায় দুবেলা দু'মুঠো খেয়ে-পড়ে শান্তিতে থাকতে।

জুলাইয়ের সনদ এখনো প্রকাশ হয়নি, বিচারকাজ শেষ হয়নি, রাজপথে নতুন করে অস্থিরতার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রশ্ন এখন একটাই—
ড. ইউনূস কি বাস্তবতা মেনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নাকি সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে আরও জটিলতা তৈরি করছেন?

শেষ কথা

ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যেটুকু আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, তা এখনো ভরসার স্তম্ভ নয়— কেবল সম্ভাবনার ছায়া মাত্র। বাংলাদেশ আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি বৈঠক আর প্রতিটি বক্তব্য ইতিহাসের পাতায় ফলাফলের চেয়ে বেশি প্রশ্ন রেখে যাচ্ছে।

এখন দেখার বিষয়, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর কী রাজনীতিকরা সময়মতো দিতে পারবেন নাকি দেশ আরেকটি অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।

ইতিহাস ঘুরে দাঁড়ায় তখনই, যখন যুগের দুই প্রান্ত এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। ২০২৫ সালের জুনে লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের ছায়ায়, যেখান থেকে একদিন বাঙালি অভিবাসীরা বর্ণবাদ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল, ঠিক সেখানেই এবার মিলিত হলেন বাংলাদেশের দুই প্রতীক-অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

এই বৈঠক শুধুই দুই ব্যক্তির সাক্ষাৎ নয়-এ এক সম্ভাব্য বিপ্লবের বীজরোপন হয়েছে। শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে যখন ছাত্র-জনতা, যুবক-যুবতি, শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী জেগে উঠেছে, ঠিক তখনই বিদেশের মাটিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস ও রাজনৈতিক সংগ্রামের উত্তরাধিকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মিলে ইতিহাসের নতুন অধ্যায় রচনার ঘোষণা দিলেন।

ড. ইউনূস শুধু একজন নোবেলজয়ী নন, তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনার প্রতীক। যে বাংলাদেশকে দলীয় দুঃশাসন, দখলদারি বিচারব্যবস্থা ও একনায়কতান্ত্রিক প্রশাসন গ্রাস করেছে, সেখানে রাষ্ট্রের নতুন কাঠামো, নতুন সংবিধান ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখা মানুষ আজ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।

অন্যদিকে, তারেক রহমান; যিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক নির্বাসনে থেকেও আন্দোলনের ছায়াশক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন, তার ভূমিকাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে কাঁপতে থাকা একটি রাষ্ট্রের কাছে তারেক রহমান সেই উত্তরাধিকারী, যিনি 'সিভিল মিলিটারি ট্রানজিশন'-এর যুগে জনগণের সমর্থন নিয়ে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।

রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নীলনকশা?

এই বৈঠকে ঠিক কী আলোচনা হয়েছে, তার বিস্তারিত জানা না গেলেও কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সূত্র বলছে, "বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো" ও "একটি নির্দলীয়, আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষিত অন্তর্বর্তী সরকার" গঠনের প্রাথমিক ধারণা বিনিময় হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ড. ইউনূস এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন-যেখানে তারেক রহমান রাজনৈতিক ভারসাম্য নিশ্চিত করবেন।

এই যুগল নেতৃত্ব বাংলাদেশকে কি দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যান্ডেলা-মবেকি মডেলে নিয়ে যেতে চায়? যেখানে একজন শান্তিকামী ন্যায়ের প্রতীক আরেকজন রাজনৈতিক কৌশলের বাস্তবায়ক হন।

শেখ হাসিনার পতনের প্রাক-মঞ্চ

এই ঐতিহাসিক বৈঠক এমন এক সময়ে হলো, যখন বাংলাদেশের জনগণ বিদ্যুৎ সংকট, দ্রব্যমূল্যের জ্বালা, বিচারহীনতার ক্ষোভ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতায় অতিষ্ঠ। রাষ্ট্রযন্ত্র যখন চরম দুর্নীতির ভারে নুয়ে পড়েছে, তখন এই নতুন জোট-নব্য গণঐক্য বা ‘রাষ্ট্র পুনর্গঠনের জোট’-জনতার মনে আশার আলো জ্বালাতে পারে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের উচিত শক্তিশালী নাগরিক মঞ্চ গড়ে তোলা, যাতে করে এই ধরনের নেতৃত্বকে জনগণের দাবির সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। ভবিষ্যতের রাষ্ট্র গঠনে সংবিধান পুনর্লিখন, বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং এক সত্যিকারের অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের দাবিতে একটি বিপ্লবী গণচেতনার সৃষ্টি করতে হবে।

জনপ্রত্যাশার দেশ গড়তে লন্ডনের সাক্ষাৎকার হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। সময়ের দায়ে যদি এই দুই নেতা সত্যিকার অর্থেই জনগণের দিকেই থাকেন, তবে ভবিষ্যৎ ইতিহাস তাদেরকে 'নতুন বাংলাদেশের স্থপতি' হিসেবেই স্মরণ করবে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.