শাহীন আবদুল বারী ও সামিউর রহমান লিপু
Published:2025-12-31 17:26:48 BdST
আপষহীন অভিযাত্রার বর্ণাঢ্য সমাপ্তিদেশনেত্রীর রাজসিক বিদায়
যাদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; সেই অগণিত মানুষের চোখের জল, শ্রদ্ধা আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় চির বিদায় নিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
বিদায়ের এই অন্তিম লগ্নেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় তৈরি করে গেলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। শুধু দেশেই নয়, মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ এক জানাজার সাক্ষী হলো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ।
বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দাফন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জিয়া উদ্যানে তার স্বামী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শনের পর লাশবাহী খাঁটিয়া ধরেন ড. মিজানুর রহমান আজহারী, আল্লামা মামুনুল হক প্রমুখ। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারা বেগম খালেদা জিয়ার মরদেহ নিজ কাঁধে বহন করে নিয়ে যান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধির কাছে।
খালেদা জিয়াকে কবরে নামানোর সময় লাখ লাখ ভক্তবৃন্দ কান্নায় ভেঙে পড়েন। নেতাকর্মীদের বুকফাঁটা আর্তনাতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। এসময় সকলেই চোখের পানি মুছতে মুছতে বেগম জিয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া পড়েন।
দাফনকালে পরিবারের সদস্য, দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। শোক ও শ্রদ্ধায় নীরব হয়ে ওঠে পুরো এলাকা।
দাফন শেষে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা মরহুমার প্রতি সশস্ত্র সালাম জানান।
এর আগে, জানাজা শেষে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়ার মরদেহ জিয়া উদ্যানে নেওয়া হয়। দাফনকাজ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নির্ধারিত ব্যক্তিদের বাইরে অন্য কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছেন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দল-মত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে রাজনীতি ও ইতিহাসে তার নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।
স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জানাজা
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। এতে স্মরণকালের রেকর্ডসংখ্যক মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন।
জানাজা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে নিজের স্মৃতিময় কিছু মুহুর্তের উল্লেখ করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়ার এক পর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এসময় তার বাধভাঙ্গা কান্না উপস্থিত সবাইকে আবেগাপ্লুত করে।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুর ২টায় জানাজা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও লাখো মানুষের উপস্থিতিতে এক পর্যায়ে পুরো এলাকা জনস্রোতে পরিণত হয়। ফলশ্রুতিতে বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে ও জনগণের আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে জানাজা শুরু হতে বেশ বিলম্ব হয়।
জানাজা শুরুর আগে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার মানুষ শান্ত ও সুশৃংখলভাবে কাতারে দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন।
পরিশেষে, নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা পর বেলা ৩টা ৩ মিনিটে পূর্ন ধর্মীয় মর্যাদায় বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা শুরু হয়। জানাজায় ইমামতি করেন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল মালেক।
শোকাবহ পরিবেশে বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা সম্পন্ন হওয়ার পর মরহুমার রুহের মাগফিরাত কামনায় মোনাজাত করা হয়। এসময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রু, কেউ নীরবে হাত তুলে দোয়া করেন।
লোকারণ্য মানিক মিয়া এভিনিউ
বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন।
জানাজাস্থল সংসদ ভবনের দক্ষিন প্লাজা ছিল লোকে লোকারণ্য। যেন তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। জানাজায় অংশ নিতে উপচে পড়া জনতার ভিড় শুধু মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ নয়, আশপাশের কয়েক কিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত হয়।
এক পর্যায়ে জনতার এই স্রোত একদিকে বিজয় সরণি, খামারবাড়ি মোড়, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, পান্থপথ এবং অন্যদিকে শেরে বাংলা নগর, আসাদগেট, কলেজগেট ও শাহবাগসহ অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
এসময় বিভিন্ন ভবনের ছাদ, ওভারব্রিজসহ যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন। এছাড়া আশেপাশের কয়েকটি মেট্রোরেল স্টেশনেও অনেকে দাঁড়িয়ে যান বেগম জিয়ার জানাজার নামাজ আদায় করতে। অনেকে আবার ব্যাপক জনসমাগম ঠেলে সময়মতো আসতে না পেরে জানাজার নামাজ আদায়ে ব্যর্থ হন।
বাংলাদেশের ইতিহাসের জননন্দিত ও অবিসংবাদিত রাজনীতিবিদ বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নিতে না পেরে অনেককেই অশ্রুসিক্ত নয়নে আক্ষেপ করতে দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিকট অতীতে এতো বড় জানাজা দেখেনি দেশবাসী।
মায়ের জন্য তারেক রহমানের দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা
পরিবারের তরফে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান প্রয়াতের জন্য সবার কাছে দোয়া চান।
তিনি বলেন, “আমি মরহুমা বেগম খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক রহমান। আমি আজকে এখানে উপস্থিত সকল ভাইয়েরা এবং বোনেরা-যারা উপস্থিত আছেন, মরহুমা বেগম খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় যদি আপনাদের কারো কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। আমি সেটি পরিশোধের ব্যবস্থা করবো ইনশাআল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, “একই সাথে উনি জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় উনার কোনো ব্যবহারে, উনার কোনো কথায় যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে মরহুমার পক্ষ থেকে আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। দোয়া করবেন। আল্লাহ তাআলা যাতে উনাকে বেহেশত দান করেন।”
রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন
বেগম জিয়ার জানাজায় উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ।
এছাড়া সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক সহকর্মী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিত্ব এবং সর্বস্তরের মানুষ জানাজায় অংশ নেন।
জানাজার সময় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ডান পাশে ছিলেন প্রধান বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, তারপরে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান এবং সরকারপ্রধানের বামপাশে খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান এবং এরপরে দাঁড়ান নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম মজুমদার।
প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি তার সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান, ফাওজুল কবির খান, আ ফ ম খালিদ হোসেন, আলী ইমাম মজুমদার, সি আর আবরার, এম সাখাওয়াত হোসেন একই সারিতে দাঁড়িয়ে জানাজার নামাজ আদায় করে।। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকেও জানাজায় দেখা গেছে।
জানাজায় শরিক হোন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ বিএনপির সর্বস্তরের নেতারকর্মীরা জানাজায় শরিক হোন।
রাজনীতিকদের মধ্যে জামায়াত ইসলামীর মিয়া গোলাম পরওয়ার, শামীম সাঈদী, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, এনসিপির নাহিদ ইসলাম ও হাসনাত আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মামুনুল হক উপস্থিত ছিলেন, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরানকে দেখা গেছে। ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের আহমাদুল্লাহও বিএনপি নেত্রীর জানাজায় অংশ নেন।
কূটনীতিকদের বিনম্র শ্রদ্ধা
বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অকাল প্রয়ানে ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বেগম জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং দাফন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বিদেশি কূটনীতিকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
তীব্র শীত উপেক্ষা করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আজ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পিকার সরদার আয়াজ সাবিক, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডি এন ধুঙ্গেল, মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতির উচ্চ শিক্ষা, শ্রম ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী আলি হায়দার আহমেদ, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বালা নন্দা শর্মা, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিজিতা হেরাথ।
এছাড়া, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, রাশিয়া, চীন, ইরান, কাতারসহ ৩২ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত এবং ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন মিশনের প্রধানরাও নিজ নিজ দেশের পক্ষে খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা জানাতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে শেষ যাত্রায় অংশ নিয়েছেন।
লোকারণ্য মানিক মিয়া এভিনিউ
এদিন দুপুর ২টায় জানাজা শুরুর কথা থাকলেও ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখো নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে মানুষের বিস্তৃতি আশপাশের এলাকা বিজয় সরণি, খামারবাড়ি মোড়, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, পান্থপথ, শেরে বাংলা নগর, কলেজগেট, আসাদগেট ও শাহবাগসহ অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
বিভিন্ন ভবনের ছাদ ও ওভার ব্রিজসহ যে যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়েছেন। চাপ ঠেলে সময় মতো আসতে না পেরে অনেকে জানাজা পাননি। ধারণা করা হচ্ছে, নিকট অতীতে এতো বড় জানাজা দেখেনি দেশবাসী।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রামে ভরপুর। কারাবরণ, অসুস্থতা ও রাজনৈতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি কখনোই নেতৃত্বের দাবিতে নীরব হননি। তাঁর জীবন প্রমাণ করে—রাজনীতি কেবল ক্ষমতার বিষয় নয়, এটি আদর্শ, বিশ্বাস ও আত্মত্যাগের নাম।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির চেয়ারপারসন, যিনি ১৯৯১ সাল থেকে তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নির্বাচিত নারী সরকারপ্রধান।
বেগম জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন কেবল ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছানোর গল্প নয়; এটি ছিল প্রতিকূলতা, আত্মত্যাগ, রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বেগম জিয়া দেশের রাজনীতিতে এক অনন্য রেকর্ডের অধিকারী। নির্বাচনী ইতিহাসে তার এই অনন্য রেকর্ড হলো পাঁচটি জাতীয় নির্বাচনে ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবগুলোতে জয়ী হওয়া। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি পাঁচটি পৃথক আসন থেকে নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তিনটি আসনেই বিজয়ী হন।
তাঁর নেতৃত্বে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরায় প্রবর্তিত হয়, যা বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, নারী উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও গ্রামীণ উন্নয়নে তাঁর সরকারের নীতিমালা উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।
২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক সংস্কারে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মতপার্থক্য ও বিতর্ক তাঁর এই শাসনামলকে জটিল করে তোলে। তবুও সমর্থকদের কাছে তিনি ছিলেন গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের এক অটল প্রতীক।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদারের ঘরে তার জন্ম। তার বাবা ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে দেশভাগের পর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে আসেন। তাদের আদি বাড়ি ফেনীতে। তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৬০ সালে তিনি জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করেন।
জিয়াউর রহমান বীর উত্তম রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর বেগম জিয়া ফার্স্ট লেডি হিসেবে তার সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সফরে অংশ নেন। এসময় তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং নেদারল্যান্ডসের রানি জুলিয়ানা সহ বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
গৃহবধূ থেকে ক্ষমতার শীর্ষে
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে এক গভীর মোড় পরিবর্তন আনে। ব্যক্তিগত শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে তিনি রাজনীতির কঠিন ময়দানে অবতীর্ণ হন।
উল্লেখ্য যে, ৪৪ বছর আগে রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হন সেনাবাহিনীর বিপথগামী একদল সদস্যের হাতে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে খালেদা জিয়া অবস্থান করছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে।
দেশের এই চরম সংকটময় মুহূর্তে বিএনপি ছিল বিপর্যস্ত। দলের নেতৃত্ব কে নেবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তা দিয়ে দ্রুতই দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এবং একই বছরের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯৩, ২০০৯ এবং ২০১৬ সালের কাউন্সিলে তিনি আরো তিনবার চেয়ারপারসন হন।
দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হন তিনি। দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কোনো সমঝোতা ছাড়াই দেশ ও জনগণের স্বার্থে আন্দোলন চালিয়ে যান। এতে এরশাদের পতন ত্বরান্বিত হয়।
১৯৮৭ সাল থেকে তিনি এরশাদ হটাও এক দফা আন্দোলন শুরু করেন এবং দীর্ঘ সংগ্রামের ফলেই ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।
১৯৯১ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয়বার এবং ২০০১ সালে জোটগতভাবে নির্বাচন করে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এছাড়া, সার্কের চেয়ারপারসন হিসেবে তিনি দুইবার দায়িত্ব পালন করেন।
গ্রেফতার-নির্যাতনের মুখেও আপসহীন নেতৃত্ব
আশির দশকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল সাহসী ও দৃঢ়। গ্রেপ্তার, নিপীড়ন ও রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি আপস করেননি। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসনের পতন এবং গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁর নেতৃত্ব ছিল ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তিনি গ্রেফতার হন।
ওয়ান ইলেভেনের সময়ও তার ওপর গ্রেফতারি ঝড় নেমে আসে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তাকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ কারাবাসের পর তিনি সব মামলায় জামিন পান। কারাগারে থাকাকালে তাকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হলেও তিনি দেশ ছাড়েননি।
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। এই বাড়িটিতে তিনি ২৮ বছর বসবাস করছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার বাড়িটি তার নামে বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
গত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়। রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের আপসহীন নেত্রীতে পরিণত হয়েছিলেন।
দেশ ছাড়ার জন্য তীব্র চাপ উপেক্ষা করে তিনি তার অবস্থান থেকে সরে যাননি। গত ১৫ বছরে নানা নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে, কারাগারেও থাকতে হয়েছে। তবুও খালেদা জিয়া কোনো আপস করেননি।
বেগম খালেদা জিয়ার পুরো রাজনৈতিক যাত্রা দৃঢ়তা, আপসহীনতা এবং সংগ্রামের প্রতীক হয়ে আছে। তাই তিনি হয়ে উঠেছেন দেশের রাজনীতিতে হার না মানা সংগ্রামের নাম।
আজ তাঁর প্রস্থান একটি যুগের অবসান ঘটাল। বেগম খালেদা জিয়া ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন একজন সাহসী নারী নেত্রী হিসেবে, যিনি কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের এক শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.
