April 29, 2024, 7:41 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2023-12-05 02:01:57 BdST

নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে হাজার কোটি টাকা লোপাটব্যাংকপাড়ায় নতুন মাফিয়ার সন্ধান পেল দুদক


ব্যাংক লোপাটে নতুন মাফিয়ার সন্ধান পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নামসর্বস্ব একাধিক প্রতিষ্ঠান খুলে ‘পিকে হালদার স্টাইলে’ আত্মসাৎ করেছেন হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি অন্তত সাতটি ব্যাংক থেকে এই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

দুদকের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মিলেছে অর্থ লোপাটের দালিলিক তথ্য-প্রমাণও। ব্যাংক পাড়ায় আলোচিত নতুন এই মাফিয়ার নাম আলী হায়দার রতন।

অভিযোগ আছে, তার কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ৬০৯ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ফেরত পায়নি পাঁচটি ব্যাংক। এরপরও বেসরকারি একটি ব্যাংক রতনের নতুন প্রতিষ্ঠানের নামে রাতারাতি ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয়।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছেও এই ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে রতনকে তলব করেছে দুদক। আজ তার দুদকের মুখোমুখি হওয়ার কথা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

যত টাকা তার লোন

আলী হায়দার রতন সাতটি ব্যাংক থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা লোন নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। দুদকের অনুসন্ধানী একটি দল এই সব ঋণের বিপরীতে ব্যাংকে জমা সব ধরনের রেকর্ডপত্র, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও যাচাই করেছে। তারপরও এসব রেকর্ডপত্র অধিকতর যাচাই-বাছাই করে ঋণ জালিয়াতির সত্যতার প্রমান মিলেছে। এরই প্রেক্ষিতে রতনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক।

ঋণ জালিয়াতিতে জড়িত সন্দেহভাজন সকল ব্যাংক কর্মকর্তাদের ধারাবাহিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সবার বক্তব্য রেকর্ড করার পরই এ সংক্রান্ত মামলা ও রতনের মালামাল ক্রোক করার জন্য আদালতের অনুমতি চাওয়া হবে।

এসব বিষয়ে আলী হায়দার রতনকে একাধিক গণমাধ্যমের সাংবাদিক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, শুনেছি হাইকোর্টের নির্দেশে দুদক ব্যাংক ঋণের বিষয়ে একটি তদন্ত করছে । আমি এ ব্যাপারে কোনো পার্টি না। আমার সঙ্গে দুদক কখনও যোগাযোগ করেনি। আমি প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যবসা করি। আমার ১০টি কোম্পানি আছে। এর মধ্যে কয়েকটির নামে এখনো ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে । ফলে আমার প্রতিষ্ঠানের নামে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ থাকলে সেটা কি দোষের কিছু হয়?

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানের নামে বর্তমানে ঋণের পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকার বেশি হবে না। তবে আমার কোনো খেলাপি ঋণ নেই।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রামের একটি কোম্পানির নামে ২৬টি ব্যাংকে যদি ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ থাকতে পারে তাহলে আমি ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলে কার কি ক্ষতি?

সবাই তো বড় হওয়ার জন্যই ব্যবসা করে। আমি ব্যবসা করতে গিয়ে আইনের বাইরে কিছু করিনি।

ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করা রেকর্ডপত্র যাচাই-বাছাই করে দুদক জানতে পেরেছে, কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ধারাবাহিকভাবে ৬০৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন আলী হায়দার রতন।

ঋণখেলাপি কোনো প্রতিষ্ঠান নতুন করে কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারে না। তাই কৌশল হিসাবে ব্র্যান্ড শেয়ার ট্রেডিং নামের নতুন একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন রতন।

বাস্তবে এই কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে কর্মকর্তাদের সহায়তায় ‘পিকে হালদার স্টাইলে’ নতুন করে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ নেন। এই অর্থের কিছু অংশ দিয়ে কোম্পানির নামে জায়গা-জমি কেনেন ও বাকী টাকা দেশের বাহিরে হুন্ডি করে পাচার করেন।

একই কায়দায় তার আরেকটি প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি দুটি ব্যাংক থেকে কয়েকশ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং অবশেষে আত্মসাতও করেছেন বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে । রাতের আঁধারে ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে রতনের অর্থ তোলার ঘটনা মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হয়।

বিএফআইইউর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দুদক নিশ্চিত হয়েছে, ব্র্যান্ড শেয়ার কোম্পানির নামে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে বেসরকারি এক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। ঋণ আবেদনে প্রতিষ্ঠানটির মালিক দেখানো হয়েছে মোহাম্মদ আতাউর রহমান ও মো. মামুন রশিদকে। কিন্তু ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে অবস্থিত রতনের ইনফ্রাটেক কনস্ট্রাকশনের অফিসকেই ব্র্যান্ড শেয়ার কোম্পানির অফিস হিসাবে দেখানো হয়েছে।

ব্র্যান্ড শেয়ার কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই ১০ জানুয়ারি বেসরকারি ওই ব্যাংকে ৩৫০ কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়। আবেদনের দিনই ব্যাংকটির গুলশান শাখার ব্যবস্থাপকসহ তিন কর্মকর্তা রতনের ধানমন্ডির অফিস পরিদর্শন করে মতামত দেন, ‘গ্রাহক প্রচুর পরিমানে জ্বালানি তেল, রাসায়নিক সামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানি করে।’ অথচ উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামে গ্রাহকের এক টাকার পণ্যসামগ্রী আমদানির রেকর্ড নেই।

একই কায়দায় অন্য পাঁচটি ব্যাংক থেকে নেওয়া ৫৫৯ কোটি টাকা ঋণের বেশিরভাগ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন রতন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, আলী হায়দার রতনের ন্যাশনাল ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকা। এত কিছুর পরও নানা আপত্তির মুখে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর রাত ৯টায় ন্যাশনাল ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ২৮ কোটি টাকা তোলার ঘটনায় সেই সময় বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে আলোচিত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বয় শাখার দায়িত্বশীলের অনেক আপত্তি ছিল এই বিষয়ে। তবুও ব্যাংক আগের দিন এই ঋণ ছাড় করেছিল বলে নথিপত্রে প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকে আলী হায়দার রতনের লোনের পরিমাণ ২৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বনশ্রী শাখা থেকে ঋণের এই অর্থ তুলে বিদেশে পাচার করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এরপরও দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি আরেকটি ব্যাংকে রতনের ঋণের পরিমাণ ২৫৮ কোটি টাকা। যার সিংহভাগই বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানী টিম জানতে পেরেছে ।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা