May 2, 2024, 8:39 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2024-03-18 15:30:11 BdST

সবলে দুর্বল ব্যাংক যেভাবে বিলীন


দেশের ব্যাংকিং খাত শক্তিশালী করতে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার (মার্জার) উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এই বিষয়ে এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ব্যাংকগুলো চাইলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিজেরাই একীভূত হতে পারবে। তা না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন অবস্থানের পর পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। পর্যায়ক্রমে আরও সাত থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংক অন্য কোনো সবল ব্যাংকে বিলীন হবে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকের একীভূত করার ক্ষমতা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই ক্ষমতা বলেই সাত থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে কয়েকটি ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা করছে আর্থিক খাতের এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ডিসেম্বরের মধ্যে ব্যাংকগুলো নিজেরা একীভূত হতে না পারলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৭৭ ধারা প্রয়োগ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই প্রক্রিয়ায় দুর্বল ব্যাংকের সম্পদ (অ্যাসেট) ও দায় (লায়াবিলিটিস) বাদ দিয়ে যে পরিমাণ শেয়ার থাকবে, ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডাররা সেই অনুপাতে সবল ব্যাংকের মালিকানা পাবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের বর্তমানে ১৫টির মতো দুর্বল ব্যাংক রয়েছে। এগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক’ ব্যবহার করে তাদের আর্থিক অবস্থা নিজেরাই নির্ণয় করতে পারবে। এরপর যেসব ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা রয়েছে, সেগুলোকে কাটিয়ে উঠতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ব্যাংকগুলো নিজেরা আলোচনা করে একাধিক ব্যাংক একীভূত হতে পারবে। যদি তারা নিজেরা একীভূত না হয়, তাহলে ডিসেম্বরে ব্যাংকের আর্থিক হিসাব পর্যালোচনা করে আগামী মার্চ থেকে ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করা হবে মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য এবং প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের কতটা ঘাটতি রয়েছে, তার ভিত্তিতে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ‘নিজেরা একীভূত হতে চাইলে আগামী ৬ মাসের মধ্যেই ব্যাংকগুলোকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। না হয় আগামী মার্চে ব্যাংকের ডিসেম্বরভিত্তিক আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

যে প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছায় একীভূত হবে ব্যাংক

যদি দুই বা তার অধিক ব্যাংক নিজেরাই একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতিক্রমে তাদের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হবে। এই চুক্তির অধীনে তারা একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করবে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক দুই ব্যাংকেরও সম্পদ ও দায় নির্ধারণের জন্য একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে (অডিট ফার্ম) নিয়োগ দেবে। এ ক্ষেত্রে নিরীক্ষকের ব্যয় বহন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ২০০৭ সালের একীভূত নীতিমালা অনুযায়ী এই ব্যয় বহন করত সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। কিন্তু ব্যাংক যাতে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করতে না পারে, সেজন্যই এই দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নেওয়া হয়েছে। নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সম্পদ থেকে দায় বাদ দেওয়া হবে। এরপর যে পরিমাণ সম্পদ থাকবে, তার ভিত্তিতে শেয়ারহোল্ডারদের আনুপাতিক মালিকানা নির্ধারণ করা হবে এবং সে অনুযায়ী সবল ব্যাংকের শেয়ার দেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংকগুলোকে সম্পদ ও দায় নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হলে তারা অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। এতে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে ঝামেলা তৈরি হতে পারে। এজন্যই এই দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে। এই অডিটের অর্থও পরিশোধ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

এ ছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এক বা একাধিক ব্যাংক নিজেরা একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তাদের পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমতি নিতে হবে। আর তালিকাভুক্ত না হলে এই অনুমতি প্রয়োজন হবে না।

গড়ে তোলা হবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি

দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলো মন্দ সম্পদের পরিমাণ অনেক বেশি। তাই ব্যাংক একীভূত করার আগে গড়ে তোলা হবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। যারা দুর্বল ব্যাংকের খারাপ সম্পদগুলো কমমূল্যে ক্রয় করে নেবে। এতে দুর্বল ব্যাংক ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে তার খারাপ সম্পদের দায় বহন করতে হবে না। একই সঙ্গে তুলনামূলক ভালো ব্যাংকেরও খারাপ সম্পদগুলো কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে। এর পরই ব্যাংকের চূড়ান্ত সম্পদ ও দায় নির্ধারণ করা হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, খারাপ অ্যাসেটের পরিমাণ বেশি হলে বিদেশি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতির মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে। বিশেষ করে বিদেশি ব্যাংকগুলো এসব ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্য করতে চায় না। এই কারণে দেশীয় ব্যাংকগুলোকে দেশে সক্রিয় বিদেশি ব্যাংকগুলোর সহায়তা নিতে হয়। এর মূল্য হিসাবে ওইসব বিদেশি ব্যাংকগুলোকে আড়াই থেকে ৩ শতাংশ কমিশন গুনতে হয়। অথচ পাকিস্তানেও এই কমিশনের পরিমাণ মাত্র ১ থেকে দেড় শতাংশ। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে খারাপ অ্যাসেট বিক্রি করে দিলে বিদেশি বাণিজ্যে কম কমিশন গুনতে হবে ব্যাংকগুলোকে। এতে কমিশন হিসেবে বেরিয়ে যাওয়া ডলার বেঁচে যাবে।

যেই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একীভূত করবে ব্যাংক

সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৭৭ক ধারায় (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘অন্য কোন আইন বা কোন চুক্তি বা কোন দলিল বা এই আইনের অন্য কোন বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যাংক-কোম্পানির বা উহার আমানতকারীগণের স্বার্থে বা জনস্বার্থে উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে উহার বিষয়ে আশু সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানির কার্যাবলি এবং উহার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করিতে পারিবে।’

অর্থাৎ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি ঋণ, তারল্য এবং প্রতিষ্ঠানে সুশাসনের ঘাটতি দূর করতে ব্যাংকগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হবে, যা বর্তমানে চলমান। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৭৭ ধারা প্রয়োগ করে সরকারের পরামর্শে ক্রমে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ বন্ধ করে দিতে পারবে। এরপর বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে ব্যাংক যদি তাদের শর্ত পূরণ না করে, তাহলে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৭৭ক ধারায় (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই ধারার অধীন গৃহীত ব্যবস্থায় যদি কোন ব্যাংক-কোম্পানি পুনরুদ্ধার কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় বা পুনরুদ্ধার কর্ম পরিকল্পনা অনুসরণ না করিয়া উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, প্রধান নির্বাহী বা ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক-কোম্পানি বা উহার আমানতকারীদের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ অব্যাহত রাখে, তাহা হইলে বাংলাদেশ ব্যাংক, আমানতকারীদের স্বার্থে বা জনস্বার্থে উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে, ধারা ৭৭-এর বিধান সাপেক্ষে, অন্য কোন ব্যাংক-কোম্পানির সহিত বাধ্যতামূলক একত্রীকরণ বা উহার পুনর্গঠন বিষয়ে যে কোন এক বা একাধিক বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে পারিবে।’

আর ৭৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যাংকের ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিতকরণ, পুনর্গঠন বা একত্রীকরণের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বিধান বা আপাতত বলবৎ আইন বা কোন চুক্তি অথবা অন্যকোন দলিল যাই থাকুক না কেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, কোন ব্যাংকের ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার প্রয়োজন রয়েছে বা তাহলে সেই রূপ আদেশ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নিকট আবেদন করতে পারবে। সরকার অনুমতি দিলে ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

উপধারা (১) এ আদেশ বলবৎ থাকাকালে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে, জনস্বার্থে বা আমানতকারীদের স্বার্থে বা উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার স্বার্থে বা দেশের সামগ্রিক ব্যাংক-ব্যবস্থার স্বার্থে উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির পুনর্গঠনের বা অন্য কোনো ব্যাংক প্রতিষ্ঠান, অতঃপর এই ধারার হস্তান্তর গ্রহীতা ব্যাংক বলিয়া উল্লিখিত, এর সহিত উক্ত ব্যাংক-কোম্পানির একত্রীকরণের জন্য স্কিম প্রণয়ন করা প্রয়োজন, তাহা হইলে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুরূপ স্কিম প্রণয়ন করিতে পারিবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে কোনো দুর্বল ব্যাংককে একীভূত করার প্রয়োজন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের পরামর্শক্রমে সেই কার্যক্রম শুরু করবে। অর্থাৎ এটি একটি বড় সিদ্ধান্ত হওয়ায় সরকারকে অবহিত করেই ব্যাংক একীভূত করতে হবে। তবে ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।’

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা