May 17, 2024, 11:34 pm


ঐতিহ্যের ঢাকা ডেস্ক:

Published:
2024-04-30 15:13:05 BdST

শিক্ষায়-শিল্পে নবাব পরিবারের অবদান


নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকার আহসান মঞ্জিলে ১৮৭১ সালের ৭ জুন জন্মগ্রহণ করেন। কার্জন হলে পূর্ববঙ্গের ছোটলাট ল্যান্সলট হেয়ারের বিদায় এবং বেইলী-এর স্বাগত অনুষ্ঠানে নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে ২৯ জানুয়ারি তিন দিনের সফরে ঢাকা আসেন।
এ সময় নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ ১৯ জন মুসলিম নেতার একটি প্রতিনিধি দল ৩১ জানুয়ারি গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন, ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও নবাব সলিমুল্লাহ জীবদ্দশায় এ বিশ্ববিদ্যালয় দেখে যেতে পারেননি। ১৯১৫ সালের রাত ২-৩০ মিনিটে তার কলকাতার চৌরঙ্গী রোডস্থ ৫৩ নম্বর বাড়িতে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে নবাব সলিমুল্লাহ ইন্তেকাল করেন।
নবাব সলিমুল্লাহর দান করা জমিতে বুয়েট প্রতিষ্ঠিত। ১৯০২ সালে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠায় তিনি তার পিতার দেয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুসারে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা মঞ্জুর করেন। ১৯০৮ সালে নবাব সলিমুল্লাহ আরও অর্থ দান করে পিতার নামে স্কুলটির নামকরণ করেন ‘আহসানউল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং।’
১৯৪৭ সালের পর স্কুলটি কলেজে উন্নীত হয়। মুসলিম লীগ সরকার ১৯৬২ সালে কলেজটির উন্নয়ন করে প্রতিষ্ঠা করে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় যা ছিল তদানীন্তন প্রদেশের প্রথম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বাধীনতার পর এটির নামকরণ করা হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বুয়েট)।
এতিম মুসলিম ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য ১৯০৮ সালে আজিমপুরে ২৮ বিঘা জমি দান করে সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করেন এতিমখানা।
পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় নবাব সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। লেখাপড়ার জন্য এতিমখানায় ছেলেদের জন্য একটি এবং মেয়েদের জন্য একটি করে দুটি স্কুল রয়েছে।
শত শত এতিম ছেলেমেয়ের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও লেখাপড়ার যাবতীয় ব্যয় নবাব সলিমুল্লাহ মৃত্যু পর্যন্ত নিজের পকেট থেকে করেছেন।
১৮৬৩ খ্রি. নওয়াব আবদুল লতিফের মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে নওয়াব খাজা আবদুল গনি ও খাজা আহসানুল্লাহ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
১৮৭৮ খ্রি. সৈয়দ আমীর আলী ‘সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করলে ঢাকার নওয়াব তাতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন।
শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের সংখ্যানুপাতে সুযোগ আদায়ের লক্ষ্যে ওই অ্যাসোসিয়েশন সরকারকে স্মারকলিপি দেয়ার জন্য ১৮৮৫ খ্রি. এক স্বাক্ষর অভিযান চালায়।
নওয়াব আবদুল গনি এ অঞ্চলের ৫ হাজার লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ১৮৮৫ খ্রি. নভেম্বর মাসে বঙ্গীয় সরকারের কাছে এক স্মারকলিপি পেশ করেন।
১৮৭৭ সালে জাহাজে করে জ্ঞানদান্দিনী, তিন সন্তান নিয়ে পুরুষবিহীন একা বিলেতে যান যেটি ভারতবর্ষে সে সময় ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। নবাবনন্দিনী পরীবানু ১৯২০ সালে কন্যা জুলেখা বানুকে সঙ্গে নিয়ে একা প্লেনে করে ইংল্যান্ডে বেড়াতে গিয়েছিলেন, সে কথাটি আমরা কয়জন জানি?
ঢাকার নবাব পরিবারের বিদুষী সদস্যা পরীবানু নবাব খাজা আহসানউল্লাহর কন্যা। জন্ম ১৮৮৪ সালের ১ জুলাই।
তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন। শিখেছিলেন ঘোড়ায় চড়া, জমিদারির কাজকর্মও। ১৯১৯ সালে পরীবানু ৬০ বিঘা জমিসহ শাহবাগ বাগানবাড়ীর দক্ষিণাংশ নবাব হাবিবুল্লার কাছ থেকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন।
এরপর থেকে তিনি ঢাকার সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বেড়ানোর জন্য প্রতি শনিবার বাগানটি উন্মুক্ত রাখার ব্যবস্থা রাখেন।
সম্ভবত সেই থেকেই লোকমুখে পরীবাগ নামটি বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠে। ঢাকার বিভিন্ন উন্নয়নে তিনি এবং তার বোনেরা মিলে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেছেন।
নবাব খাজা আলিমুল্লাহের মৃত্যুর পর তার ও জিনাত বেগমের সন্তান খাজা আবদুল গণি নবাব হন। রক্ষণশীল সমাজের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি মহিলাদের মঞ্চ নাটকে অভিনয়ে সাহায্য করেন। ১৮৪৬ সালে খাজা আবদুল গণি ও ইসমতুন্নেসার সন্তান আহসানুল্লাহ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। আহসানুল্লাহ একজন উর্দু কবি ছিলেন। তিনি শাহীন নাম ব্যবহার করতেন। তার কিছু নির্বাচিত কবিতা, কুলিয়াত-ই-শাহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে। তার বই তাওয়ারিক-ই-খানদান-ই-কাশ্মীরিয়া পাকিস্তানি ইতিহাস ও সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নবাব খাজা আহসানউল্লাহ এবং নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ছিলেন শিল্প ও সংস্কৃতির দুর্দান্ত অনুরাগী। দু’জনেই ১৮৮৮-৮৯ এবং ১৮৯০-১৯৬৬-এর কলকাতাভিত্তিক ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ফটোগ্রাফির বিকাশ ঘটে ঢাকায়। ১৮৯৮ সালের এপ্রিলের বসন্তে, নবাব খাজা আহসানউল্লাহ কলকাতা থেকে ‘সিনেমাটোগ্রাফ কোম্পানি’কে আহসান মঞ্জিলে আমন্ত্রণ জানান। সে অনুষ্ঠানে পরিবারের সদস্যরা এবং শহরের উচ্চবিত্তরা উপস্থিত ছিলেন। ১৯১১ সালের ১৬ ও ২২ মার্চ ‘রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ আহসান মঞ্জিলে শো প্রদর্শন করেছিল। খাজা ইউসুফজান, যাকে এর আগে নবাব উপাধি দেয়া হয়েছিল, তার সম্মানে নবাব সলিমুল্লাহ, এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। আবদুল আলীম এবং খাজা আজিজুল্লাহর বাসভবনে আরও দুটি অনুষ্ঠান যথাক্রমে ২৪ ও ২৫ তারিখে আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯১৬ সালের ৫ জুন থেকে দু’দিন ধরে নবাবজাদা খাজা আতিকুল্লাহ তার দিলখুশার বাসায় সিনেমাটির প্রিমিয়ারও করেছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শিল্পী, প্রযুক্তিবিদ এবং স্টুডিওর পুরো সুযোগ সুবিধাসহ কলকাতা ছিল চলচ্চিত্র প্রযোজনার দুর্গ। ঢাকায় এসব সুযোগ সুবিধার অভাব ছিল। নবাব পরিবারের আর্থিক সহায়তায় ওপৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯২৭-২৮ সালে নবাব পরিবারের একদল যুবক এগিয়ে এলেন। পরীক্ষার জন্য তরুণ ছেলেরা ‘সুকুমারী’ নামে একটি শর্ট ফিল্ম প্রযোজনা করেছিল। ‘সুকুমারী’ পরিচালনা করেছিলেন নাট্যকার ও জগন্নাথ কলেজের শারীরিক শিক্ষার প্রশিক্ষক অম্বুজ প্রসন্ন গুপ্ত। নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নবাব জাদা নসরুল্লাহ। মজার বিষয়, তখনকার সময় কোনো অভিনেত্রী খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। সৈয়দ আবদুস সোবহান নামে এক যুবককে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য বেছে নেয়া হয়েছিল। দিলকুশা বাগানে শুটিং হয়েছিল। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক খাজা আজাদ এবং ফটোগ্রাফি অধ্যয়নরত বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ খাজা আজমল ক্যামেরাটি রোল করেছিলেন। এ সিনেমাটি তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দালিব সাদানী, সৈয়দ আবদুস সোবহান, কাজী জালালউদ্দিন প্রমুখ। সিনেমাটি ১৯২৮-২৯-এর মধ্যে শেষ হয়েছিল, পরীক্ষার সফল সমাপ্তি। এটি ছিল চারটি রিলের সম্পূর্ণ নীরব একটি সিনেমা। দুর্ভাগ্যক্রমে চলচ্চিত্রটি সবাই দেখার জন্য কখনই উন্মুক্ত ছিল না। তবে ব্যক্তিগত পরিসরে কয়েকবার দেখানো হয়েছিল। ‘সুকুমারী’ চলচিত্রটির কোনো প্রতিলিপি আর নেই, এটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। একটি মাত্র অমূল্য স্থির ছবি (নায়ক খাজা নাসারুল্লাহ এবং নায়িকা সৈয়দ আবদুস সোবহানের সঙ্গে) বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভের কোষাগারে রয়েছে।
‘সুকুমারী’র সাফল্যের পরে নবাব পরিবারের যুবকরা আরও বড় উদ্যোগ নেয়। তারা ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি স্থাপন করে এবং ‘দ্য লাস্ট কিস’ শিরোনামে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য নীরব চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছিল। অনুপম হায়াতের ভাষ্য অনুযায়ী, খাজা আজমল নায়িকা লোলিতার বিপরীতে অভিনয় করেছেন। ডা. এমডি আলমগীরের মতে, খাজা নাসারুল্লাহ প্রথমে নায়ক ছিলেন এবং পরে কাজী জালালউদ্দিন তারও পরে খাজা আজমল স্থান পেয়েছিলেন। গ্যাংয়ের নেতা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, বিখ্যাত শিল্পী শৈলেন রায় (টোনা বাবু)। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন, খাজা আদেল, খাজা আকমল, খাজা শাহেদ, খাজা নাসারুল্লাহ এবং সৈয়দ সাহেব ই আলম। অভিনেত্রীরা হলেন লোলিতা ওরফে বুড়ি (নায়িকা), চারুবালা, দেবাবালা ওরফে দেবী এবং হরিমতি। শিল্পীদের প্রথম তিনজন এসেছিলেন পুরান ঢাকার পতিতালয় থেকে আর হরিমতি ছিলেন সে সময়ের একজন।

সম্পাদনায়: সালাহউদ্দিন মিঠু
তথ্য সহযোগিতায়:- ওল্ড ঢাকা জার্নালিস্টস ফোরাম

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা