October 5, 2024, 9:22 pm


নেহাল আহমেদ

Published:
2024-09-16 13:28:10 BdST

জেনারেশন গ্যাপ


সাম্প্রতিক সময়ে কম গুরুত্ব পাওয়া একটি সামাজিক সমস্যা জেনারেশন গ্যাপ। অথবা হতে পারে এক ধরনের প্যারাডাইম শিফট।

প্যারাডাইম শব্দটি এসেছে গ্রীক থেকে। এটা প্রথম দিকে বৈজ্ঞানিক শব্দ হিসেবে চালু হয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এটা আমাদের প্রচলিত শব্দে ঢুকে যায় যেখানে প্যারাডাইম বলতে কোন ধরনের মডেল, তত্ত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি, ধারণা, দৃষ্টান্ত, কোন রেফারেন্সের ফ্রেমওয়ার্ক ইত্যাদি বিষয় বোঝানো হয়ে থাকে।

খুব সাদামাটাভাবে দেখলে আমরা নিজেদের যে চোখে বা দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই পৃথিবীকে দেখি (চোখের দেখা নয়) সেটাই হলো আমাদের প্যারাডাইম। এই দেখার অর্থ হলো- উপলব্ধি করা, বুঝতে পারা এবং সেটাকে ব্যাখ্যা করা।

প্রাইমারি থেকেই আমরা কম্বাইন্ড স্কুলে পড়তাম। সেখানে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা জানা শোনার সুযোগ ছিল অবারিত। স্কুলের সামনে যে মাঠ ছিল আমরা দৌড়ঝাপ করতাম। আমাদের পড়ার জন্য ছিল পাঠাগার।

পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল। সেখানে হাডুডু, কেরাম, ভলিবল নানা রকম খেলাধুলা হত। ছিল পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। শিশুদের জন্য ছিল শিশু সংগঠন। খেলা হত। আমার বাচ্চার কাছে এসব গল্প এখন রুপকথার মত মনে হয়। ওরাও খেলাধুলা করে, কিন্তু সেটা মোবাইল ফোনে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের গেম আছে।

আমরা ঘুড়ি উড়াতাম, আমার বাচ্চা ড্রোন ওড়ায়। আমরা ঠাকুরমার ঝুলি পড়তাম আর আমার বাচ্চারা ইউটিউবে হেরিপটার দেখে। আমরা তথ্য আদান প্রদান করতে চিঠি লিখতাম আর আমার বাচ্চারা ম্যাসেজ করে। শুধু কথাই বলে না ভিডিও ফোনে কুশল বিনিময় করে।

মাত্র কয়েকদিনের ব্যবঝানে আমাদের এই সাদৃশ্য পরির্বতন তা মেলাতে আমাদের দু পক্ষেরই হিমসিম খেতে হচ্ছে। পরস্পরকে বুঝে নিতে দুরত্ব তৈরি হচ্ছে কোন কোন ক্ষেত্রে। তৈরি হচ্ছে জেনারেশন গ্যাপ।

জেনারেশন গ্যাপ কম গুরুত্ব পাওয়া একটি সামাজিক সমস্যা। দুই ধরনের চিন্তার টানাপোড়েনই হয়তো বর্তমান সময়ের প্রজন্ম-ব্যবধানের মূল পার্থক্য।

এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আচার-ব্যবহার, জীবন, স্বপ্ন, বা স্বপ্নহীনতা- অনেকাংশেই পুর্বের ধরনের চিন্তাভাবনার সাথে মেলানো কঠিন। হতে পারে এটা এক ধরনের প্যারাডাইম শিফট। আমাদের চারপাশে একটু ভালোভাবে তাকালেই ব্যাপারটা খুব সহজে বুঝা যায়।

প্রায় সব পরিবারেই বাবা-মা এবং সন্তানদের মাঝে এক ধরণের অদৃশ্য দেয়াল খুব প্রকটভাবে চোখে পড়ে। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেলে প্রায় সব বাবা-মায়েরই একটা সাধারণ আক্ষেপ তৈরি হতে থাকে যে, তাদের সন্তানরা আর তাদের কথা ঠিকঠাক শুনছে না।

এই যোগাযোগ সংকটের পেছনে অনেক কারণই আছে তবে তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, পুরনোদের যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন সংস্কৃতিতে আত্মস্থ হতে না পারা, পুরনোদের পক্ষ থেকে নতুনদের উপর যেকোন কিছু চাপিয়ে দেয়ার মানসিকতা, নতুনদের মাঝে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সবজান্তা মনোভাব, পরমত অসহিষ্ণুতা এবং কমবেশি সবার মাঝেই আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা ইত্যাদি।

এই সবকিছু মিলিয়েই দুই প্রজন্মের মধ্যে তৈরি হচ্ছে পাহাড় প্রমাণ বৈরিতা, যোজন যোজন দূরত্ব। তাছাড়া বর্তমানে ডিজিটাইল একটা অন্যতম কারন।

ইন্টারনেটের কারনে এখন আমরা সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় পাচ্ছি। ফলে আমাদের জানাশোনা এবং আমাদের পৃথিবীর সাথে তাদের পৃথিবীর পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে। তাদেরই হাতে তিলে তিলে গড়ে ওঠা সাধনার ধনকে একটা সময় পরে খুব বেশি অচেনা মনে হয়। আবার সন্তানদের দিক থেকেও ভীষণ অভিমান সময়ে-অসময়ে ফুঁসে উঠে। কেবলই মনে হয় বাবা মায়েরা কখনোই তাদের কথা শুনতে চান না, বুঝতে চান না। তারা সব সময়ই নিজেদের ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো সন্তানদের উপর চাপিয়ে দিতে চান। এই চাপিয়ে দেয়ার বিষয়টা আমাদের সমাজে সবসময়ই ছিল কিন্তু দ্বন্দ্ব সংঘাত খুব বেশি ছিল না।

জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হওয়ার প্রধানতম কারণই হচ্ছে, কমিউনিকেশন গ্যাপ বা যোগাযোগ স্থাপনের সংকট। যোগাযোগ বলতে এখানে শুধু কথা বলতে পারা বা শুনে বুঝতে পারাকে বুঝানো হচ্ছে না। অনেক ব্যাপার থাকে যা বলার পরেও অপ্রকাশিত থেকে যায়।

কমিউনিকেশন গ্যাপ বলতে এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের যথাযথ মত বিনিময়ের পরও এক ধরণের দুর্বোধ্যতা বা অস্পষ্টতা থেকে যাওয়াকেই বোঝানো হয়েছে।

“জেনারেশন গ্যাপ” বা বাংলায় বলতে গেলে “প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য” বিষয়টাকে একাডেমিক চেহারায় সংজ্ঞায়িত করতে। এক কথায় বলতে গেলে জেনারেশন গ্যাপ বা প্রজন্মের বৈসাদৃশ্য হচ্ছে এক প্রজন্মের সাথে অন্য প্রজন্মের মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি-সংস্কৃতি, মতামত প্রকাশের ঢং, পরস্পরের মতকে মূল্যায়ন করার পদ্ধতি ইত্যাদির বৈসাদৃশ্য। ছোট বেলার সেই পরিবেশ এখন আর নেই। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের তাও মেনে নিতে হয়। কিন্তু কতটুকু আমরা মনে নিতে পারি।

দু'দিকের দু'রকম হিসেব। যারা উচিৎ মেনে চলে, তারা মানুষকে আর মানুষের তৈরি সমাজটাকে গুরুত্ব দেয়। তাদের সমীকরণ মেলানোর তাগিদের পেছনে কখনো থাকে অস্তিত্বের সঙ্কট থেকে মুক্তির হাহাকার, কখনো ক্রমশঃ নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে দলছুট না হয়ে যাবার ভীষণরকম আকুতি। ভয়, সামাজিক সমীকরণগুলো না মেলালে কনরাডের দ্যা হরর যদি সব গ্রাস করে?

অন্যদিকে, যারা উচিৎ-অনুচিতের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মত করে জীবনটাকে দেখতে চায়, জানতে চায়, তাদের তৃষ্ণা অথেন্টিসিটিতে। যেটাকে যেমন দেখি সেটাকে তেমন বলবোনা কেন?

অস্থির সময়ের বাস্তবতায় একাকীত্ব যখন নিত্যসঙ্গী, নিজের সাথেও বন্ধুত্ব না হলে শেষমেশ আর কিই বা থাকে। তাই নিজের সাথে সৎ হবার দরকার পড়ে, পরিণামে হয়তো প্রচলিত পথে চলা অনেকের সাথে তৈরি হয় দূরত্ব। এই দূরত্ব স্বার্থপর, কিন্তু জরুরি, এটাই স্পেস তৈরি করে নিজের মত করে ভাববার, বাঁচতে শেখার।

লেখক একজন কবি ও সাংবাদিক

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা