মতিউর রহমান
Published:2024-11-12 14:20:01 BdST
দুদকের কার্যক্রম নিয়ে জনমনে প্রশ্নদুদকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সম্পদের অনুসন্ধান করবে কোন সংস্থা?
সরকার আসে সরকার যায় তবে সবারই এজেন্ডা থাকে “দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স”। এই ঘোষনার পর জনগনের মাঝে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই হাক-ডাক দেওয়া হোক না কেন দুর্নীতির চাকা সমান তালেই ঘুরতে থাকে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর কার্যক্রম নিয়ে জনমনে হতাশা সব সরকারের আমলেই একইরকম থাকে। কারন দুর্নীতিবাজ যত বড় তাদের হাতও তত লম্বা। দেশের সাধারন জনগন কিংবা গণমাধ্যমে যখন দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের তথ্য উঠে আসে তখন যদি দুদক দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জোরালো কোন পদক্ষেপ গ্রহন করতো তাহলে দুর্নীতিবাজদের মাঝে আতংক বিরাজ করতো। কিন্তু হচ্ছে এখানে উল্টো।
দুর্নীতি দমন কমিশনে কোন ফাইল অনুসন্ধানে যেতে হলে তা বাছাই কমিটির মাধ্যমে যেতে হয়। আর বাছাই কমিটিতেই রয়েছে গলদ। দুর্নীতির অভিযোগগুলো বাছাই কমিটি নিজেদের ইচ্ছেমতো বাছাই করে। শুরু হয় দেনাদরবার কিংবা স্বজনপ্রীতি।
মূলতঃ দুদকের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে ছেদ পড়ে বাছাই কমিটি থেকে। দুদকের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা একটি গ্রুপ গোপনে অথবা বিভিন্ন মাধ্যমে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে ফায়দা লুটে নেয়। আর শুরুতেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সফলতার কবর রচনা শুরু হয়। এরপর অনুসন্ধান ও তদন্তের নামে বছরের পর বছর চলতে থাকে। অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাদের দীর্ঘসূত্রিতার সময় দুর্নীতিবাজরা অধিকতর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। বিগত পতিত সরকারের সময় মুখে মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা হলেও মূলতঃ দুর্নীতিকে পুর্নবাসিত করা হয়েছে।
আর এই কাজে সহযোগিতা করেছে পতিত সরকারের সময় দুদকের পুরো কমিশন। শুধু তাই নয় বিগত কমিশনের সময় চূড়ান্ত চার্জশিট দেওয়া অভিযুক্ত ব্যক্তিগনও আদালত থেকে জামিন নিয়ে বহাল তবিয়তে আছে। এমনকি সরকারী চাকুরীজীবীগন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করছে। অভিযুক্ত ও চূড়ান্ত চার্জশিটভূক্ত দুর্নীতিবাজরা যদি বহাল তবিয়তে ফিরে আসতে পারে তাহলে দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের স্বার্থকতা কোথায়?
দুদক কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অনিয়ম ও জবাবদিহিতা
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করে এবং তিনি ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। ঐ মামলায় দন্ডিত হয়ে দেশের পর পর তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কারাবরন করতে হয়। যা দেশের ইতিহাসে জঘন্যতম ও অমানবিক ব্যবস্থা।
১১/১১/২০২৪ই তারিখ দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তার দন্ড স্থগিত করা হয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবি আদালতে কোন প্রকার অনিয়ম হয়নি বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাহলে পতিত সরকারের বিগত যে কমিশন কর্তৃক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করেছেন ঐ সময়ে দুদক অনুসন্ধানী, তদন্তকারী, তদারকী কর্মকর্তা ও কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে? যাদের কারনে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন ও জনপ্রিয় তিন বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যা মামলায় সাজা প্রদান করে তার জীবনকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে? এ প্রশ্ন এখন জনগনের মুখে মুখে।
এরকম হাজারো অভিযোগ দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে। বিগত পতিত সরকারের আমলে কমিশনের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্পদের বিবরনী ও তাদের সময়ে দায়মুক্তিপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজদের অনুসন্ধান ও তদন্ত পুনরায় করা প্রয়োজন বলে সুশীল সমাজ ও দেশের সাধারন জনগন মনে করে।
এছাড়াও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে দুদকে এত অভিযোগ জমা পড়েছে যে এখন সমস্ত অভিযোগ আলাদা একটি কমিটি দ্বারা যাচাই-বাচাই করা প্রয়োজন। আগের বাছাই কমিটি কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে দুদকের অভিযুক্ত দুর্নীতিবাজদের ফাইল ধামাচাপা দিয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন শত শত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। উক্ত অভিযোগের প্রাপ্তি স্বীকার কপিতে শুধু গ্রহন সিল মেরে রাখা হয় কিন্তু কোন সিরিয়াল নম্বর/প্রাপ্তি নম্বর দেওয়া হয় না। উক্ত কপিতে অভিযোগ গ্রহন সাপেক্ষে প্রাপ্তি সিরিয়াল নম্বর দিয়ে রাখা হলে জানা যেত যে কতজন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। মুলতঃ দুদকে দুর্নীতি শুরু হয় বাছাই কমিটি থেকেই।
বিগত পতিত সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য, গনপূর্ত, বেসরকারী বিমান চলাচল, শিক্ষা, ব্যাংক-বীমা, নৌ পরিবহন, সহ আর্থিকখাত, বিআইডব্লিউটিএ, বিদ্যুৎ, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। আর এই সমস্ত দুর্নীতির মূল অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ হলেন সরকারদলীয় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যাংকারগন। কিন্তু এদের অধিকাংশই রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। নামকাওয়াস্তে ছোট ছোট চুনোপুটিঁদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও তারা আবার অধিকাংশই জামিনে বের হয়ে এসেছে। তাহলে দুর্নীতির মূল উৎপাটন হবে কিভাবে?
বিগত সরকার দেশে বড় বড় মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার মধ্যে অনেক প্রকল্পের কাজ শেষও হয়েছে কিন্তু প্রতিটি মেগা প্রকল্প অনুমোদনের সময় যে বাজেট ধরা হয়েছিল তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ক্ষেত্রবিশেষে কয়েকগুণ অতিরিক্ত অর্থও ব্যয় করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে বড় ধরনের শুভংকরের ফাঁকি বা দুর্নীতি সংঘঠিত হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ পতিত সরকারের অনুসারী ঠিকাদার/ব্যবসায়ী গ্রুপ পেয়েছে। প্রকল্প হাতে নিয়েই প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়েছে বহুগুন।
অতি সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে পতিত সরকারের মন্ত্রীরা কিভাবে প্রকল্প বাগিয়ে নিতেন। প্রতিটি প্রকল্পেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, আমলা ও ঠিকাদারগণের দুর্নীতির সম্পৃক্ততা রয়েছে। আর এসব প্রকল্পের মূল পৃষ্ঠপোষক একনেক প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কমিটি। এখন পর্যন্ত বড় কোন মেগা প্রকল্পে দুর্নীতির সাজা প্রাপ্তির নজির দুদকের নেই। এর প্রধান কারণ দলীয় লেজড়বৃত্তির দুদক কমিশন ও তাদের অনুগত কর্মকর্তারা।
দুর্নীতি কমিয়ে আনতে হলে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে অতি দ্রুত একটি নিরপেক্ষ ও বিতর্কমুক্ত তদন্ত কমিশন গঠন করে বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করা জরুরী বলে বিজ্ঞ মহল মনে করেন। পতিত সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও তদন্ত কর্মকর্তা দ্বারা দুর্নীতিবাজদের ধরা সম্ভবপর নয় বলে মত তাদের।
দুদকের মধ্যে সর্বপ্রথম শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। দীর্ঘদিন যাবৎ যে সমস্ত ফাইল দুদকে ধামাচাপা পড়ে আছে সেগুলো কেন এভাবে পড়ে আছে তার অনুসন্ধান করা সর্বপ্রথম জরুরী।
প্রতিটি ফাইল অনুসন্ধানের সময় অনুসন্ধান করা কর্মকর্তারা দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। এমনও দেখা গেছে বিগত বছরে যে সমস্ত ডাকসাইটের কর্মকর্তারা অবসরে গিয়েছে তার বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। নামে-বেনামে এরা অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
একজন উপ-পরিচালক তার সন্তানের বিয়েতে কোটি টাকা খরচ করেছে। এই টাকার উৎস কোথায়? কেউ কি জানতে চেয়েছে? দুদক চেয়ারম্যান থেকে কমিশনের সকল কর্মকর্তা ও স্বনামধন্য গণমাধ্যম কর্মীরাও সেই বর্ণাঢ্য কোটি টাকা খরচের বিবাহ অনুষ্ঠোনে যোগ দিয়েছেন। ঐ কর্মকর্তা স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজদের অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলো। এমনও অভিযোগ রয়েছে তিনি অর্ধশত কোটি টাকা স্বাস্থ্যখাত থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন। এখন স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন উঠছে যে এই ধরনের বিতর্কিত কর্মকর্তাদের সম্পদের অনুসন্ধান করবে কোন সংস্থা?
ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতিবাজদের নিয়ে বিগত দুইটি কমিশন কাজ করেছে। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে এই খাতে। এ পর্যন্ত ব্যাংকিংখাতের দুর্নীতির হোতাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক কোন কঠোর শাস্তি প্রদানের নজির নেই। দেশের পুরো অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দিয়ে যে সমস্ত ব্যাংকার ও অসাধু লুটেরা ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্যপ্রমাণ সহ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরও দুদক নির্বিকার বরং উল্টো গণমাধ্যমকর্মীরা হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলার আসামি হচ্ছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে শুধু ঢেলে সাজালেই হবে না দুদকের দুর্নীতিবাজ কমিশন ও কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় না আনলে দুর্নীতি দমনের কোন উদ্যোগই সফল হবে না। অধিকাংশ দুদক কর্মকর্তাদের নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। বিশেষ করে ইকবাল মাহমুদ কমিশন দেশে দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় প্রশ্রয়দাতা। উক্ত কমিশনের সকল কর্মকর্তা ও পরিচালক, মহাপরিচালক ও কমিশনারদের সম্পদের অনুসন্ধান করতে আলাদা টাস্কফোর্স গঠন করলে পতিত সরকারের সমস্ত দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের ধরা সম্ভব হবে। এরাই মুলতঃ দেশকে ধ্বংস করে দিয়েছে, অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙে দিয়েছে।
পতিত সরকারের বিদায়ের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুদক পুনর্গঠনে সার্চ কমিটি গঠন করেছে। সার্চ কমিটির সভাপতি করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো: রেজাউল হককে। এতে সদস্য হিসেবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব, বাংলাদেশের মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো: নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সরকারী কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাস্বের মোমেন ও সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রীপরিষদ সচিব মোঃ মাহবুব হোসেন।
বাছাই কমিটি চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে উপস্থিত সদস্যদের অনুন্য ৩ জনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কমিশনারের শূন্য পদের বিপরীতে ২ জন ব্যক্তির নামের তালিকা প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবে। অনুন্য ৪ জন সদস্যের উপস্থিতিতে বাছাই কমিটির ফোরাম গঠন হওয়ার কথা জারিকৃত একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে।
বিগত ২০ বছরে ৬টি কমিশন গঠন করা হয়েছে। ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ “দুর্নীতি দমন ব্যুরো” বিলুপ্ত করে একই বছরের ২১ নভেম্বর দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সম্প্রতি দুদকের চেয়ারম্যানসহ ২ জন কমিশনার পদত্যাগ করেছেন। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত করতে স্বচ্ছ একটি কমিশন গঠনের কোন বিকল্প নেই।
হিউম্যানিস্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান ড. সেলিম রেজা বলেন, দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে সর্বপ্রথম দুদককে দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে এবং দুদকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্থ “দুর্নীতি দমন ব্যুরো” বিলুপ্ত করে একই বছরের ২১ নভেম্বর দুদক প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিগত ২০ বছরে ৬টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.