May 29, 2025, 5:37 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-05-28 07:37:30 BdST

শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ গ্রেপ্তার


বাংলাদেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ত্রিমতি সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী এবং মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদ গ্রেপ্তার হয়েছেন। 

আন্ডারওয়ার্ল্ডে সুব্রত বাইনকে বলা হয় ‘গ্যাং কিলিং মাস্টার’, আর মোল্লা মাসুদকে ‘কিলিং মেশিন’। তাদের গ্রেপ্তারে সরকার ইন্টারপোলের সহযোগিতাও চেয়েছিল।

পুরস্কার ঘোষিত এই দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গতকাল কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর সোনার বাংলা সড়কের একটি ছাত্রাবাস থেকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সেই ছাত্রাবাসে আত্মগোপন করে ছিলেন।

পরে তাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ঢাকার হাতিরঝিল থেকে দুই সহযোগী শুটার আরাফাত ও শরীফকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেনাবাহিনীর অভিযানে ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগজিন, ৫৩ রাউন্ড অ্যামোনিশন এবং ১টি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়। তাদের চারজনকেই ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

মঙ্গলবার (২৭ মে) বিকেলে সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই কথা জানান আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী।

তিনি বলেন, এই অভিযান ছিল দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা ও পরিকল্পনার ফসল। অপারেশনটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ক্ষয়ক্ষতি বা সংঘর্ষ ছাড়াই পরিচালিত হয়, যা আমাদের বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় ও সহায়তা দিয়েছে সেনা সদরের সামরিক অপারেশন পরিদপ্তর, ৫৫ পদাতিক ডিভিশন, ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার বিগ্রেড, ৭১ মেকানাইজ বিগ্রেড ও এনএসআই।

আইএসপিআর জানায়, এদের নামে বিভিন্ন থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ নাশকতামূলক কার্যক্রমসংক্রান্ত মামলা রয়েছে। উল্লেখ্য, সুব্রত বাইন এবং মোল্লা মাসুদ সেভেন স্টার সন্ত্রাসী দলের নেতা এবং ‘তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী’র অন্যতম।

সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সকালে অভিযানটি পরিচালনা করা হয়। আভিযানিক দলের দক্ষতায় কোনো ক্ষয়ক্ষতি এবং নাশকতা ছাড়াই অভিযানটি সম্পন্ন হয় এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়।এই সফল অভিযান বাস্তবায়নে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ফরমেশন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

পুলিশের সূত্রগুলো বলেছেন, সুব্রত বাইন রাজধানী ছাপিয়ে বিভিন্ন জেলায় মানুষ খুন করেছেন। তার নামে উঠছে কোটি কোটি টাকার চাঁদা। ট্রিপল, ডাবলসহ নানান কৌশলে তিনি খুনের ঘটনা ঘটান। দিনরাত তার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। যখন তখন লাশ ফেলতে পারেন। সরকারের ঘোষিত শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকার অন্যতম সদস্য তিনি।

পুলিশের ঘুম হারাম করে দেওয়া এই দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীর ভয়ংকর সব অপরাধে আন্ডারওয়ার্ল্ড পর্যন্ত থাকতো অস্থির। তার অপরাধের পরিধি শুধু দেশের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ভিনদেশেও তিনি ভীষণ তৎপর। নেপালের জেল ভেঙে পালিয়েছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশেরও তিনি তালিকাভুক্ত শীর্ষ অপরাধী।

গ্রেপ্তার অভিযানের প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী জানান, গতকাল ভোর ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার দিকে সেনাবাহিনীর ৫ থেকে ৭টি গাড়ি কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুরের সোনার বাংলা সড়ক ও মসজিদের পাশের একটি তিন তলা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে অবস্থান নেয়। তিন ঘণ্টাব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান শেষে ৮টা-সাড়ে ৮টার দিকে বাড়িটির নিচতলা থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিন তলাবিশিষ্ট পুরোনো ওই বাড়িটির মালিক আলমডাঙ্গার সাবেক পৌর মেয়র, বিএনপি নেতা প্রয়াত মীর মহিউদ্দিন। কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের ঠিক পেছনে বাড়িটির অবস্থান। ৮-১০ বছর যাবৎ বাড়িটি ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দেওয়া। মীর মহিউদ্দিনের মেয়ে বাড়িটি দেখাশোনা করলেও তিনি এখানে থাকেন না। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা ছাত্রাবাস হিসেবে ভাড়া দেওয়া। নিচতলা এতদিন খালি পড়ে ছিল।

প্রত্যক্ষদর্শী কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী শাহিন আলম জানান, রোজার ঈদের পর তারা ওই বাড়ির নিচতলায় ভাড়া ওঠেন। পাশের বাড়ির হাফিজুল তাদের ভাড়া নিয়ে দেন। নিচতলায় কী হয় বা কারা থাকেন এতদিন এই বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। নিচতলায় কতজন থাকতেন তা-ও তারা জানেন না। দুই-তিন জনকে থাকতে দেখেছেন।

তিনি বলেন, ‘ছাত্রাবাসের দুই এবং তিন তলা মিলিয়ে আমরা ১৮-২০ জন ঘুমিয়ে ছিলাম। ভোরের আজানের পর আনুমানিক ৫টা ২০ মিনিটের সময় সেনাবাহিনীর ৩০-৪০ জন সদস্য আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে বাড়িতে প্রবেশ করার গ্রিলের তালা খুলতে বলেন। এ সময় মোবাইলে দাড়িওয়ালা একজনের ছবি দেখিয়ে জানতে চান এই ব্যক্তিকে আমরা চিনি কি না? এ সময় সেনাবাহিনীর সশস্ত্র তিনজন আমাদের সবাইকে দুটি রুমের মধ্যে নিরাপদে রেখে নিচতলায় অভিযান পরিচালনা করেন। সেনাসদস্যরা নিচতলার দরজা দীর্ঘ সময় ধরে ধাক্কাধাক্কি করেন। তবে কেউ গেট খুলছিল না। এক পর্যায়ে তারা দরজার ছিটকানি ভেঙে প্রবেশ করেন। প্রায় তিন ঘণ্টা অভিযান ও তল্লাশি চালানো হয়। সকাল ৮টার কিছু পরে পেছনে হাতকড়া ও মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তিকে কালো মাইক্রোবাসে ওঠানো হয়। অন্য একজনকেও কোমরে দড়ি বাঁধা অবস্থায় গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

কীভাবে বাসা ভাড়া নিয়েছিল এমন প্রশ্নের উত্তরে শাহীন জানান, আমরা এই পুরো বাসাটা ১৮জন শিক্ষার্থী মিলে মাসিক ১৭ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে থাকতাম। আমরা সবাই দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলায় থাকতাম। নিচের তলাটা ফাঁকা পড়ে ছিল। দেড় মাস আগে আমাদের বাসার পেছনের ভাড়াটে হেলাল উদ্দীন আসেন আমাদের ম্যাচের নিচের তলা ভাড়া নেওয়ার জন্য। তিনি ভাড়া নেওয়ার সময় জানান, তিনি অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা করেন। সেটির জন্য কাপড় রাখবেন এবং সেইসঙ্গে তার বাসায় অনেক গ্রেস্ট আসেন মাঝে মাঝে তারা এখানে থাকবেন। এই বলে আমাদের কাছে মাসিক ৬ হাজার টাকা চুক্তিতে বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন। বাসা ভাড়া নেওয়ার ৫-৬দিন পরেই তিনি এই বাসায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করেন এবং সেটি তার নিজের বাসা থেকে কন্ট্রোল করতেন।

নিচের তলায় যারা বসবাস করতেন তাদের সঙ্গে খুব একটা দেখা হতো না। তবে কয়েকদিন ধরে মাঝে মধ্যে রাতে একটা গাড়ি আসতো। একদিন শুধু একটি মেয়ে এবং একজন পুরুষ মানুষকে সেখানে কাপড় মেলতে দেখেন বলে জানান শাহীন নামের ওই শিক্ষার্থী।

ওই ছাত্রাবাসে থাকা ইমন নামে অপর এক শিক্ষার্থী বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের সব ছাত্রদের একত্রে রেখেছিল। পরে নিচতলা থেকে দুজনকে আটক করে নিয়ে যায়। যাদের আটক করে নিয়ে গেছে তাদের আমরা চিনি না তবে দেড় মাস আগে কাপড়ের ব্যবসা করে বলে ভাড়া নিয়েছিল। কখনো তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। বাসা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী আটকের পরে কিছুটা আতঙ্কে আছেন বলে জানান ওই বাসায় থাকা শিক্ষার্থীরা।

১৯৯০-এর গণ অভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে উত্থান ঘটে সুব্রত বাইনের। ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশের পর থেকে তিনি পলাতক ছিলেন। সুব্রত বাইনের বাবার নাম বিপুল বায়েন। মা কুমুলিনি বায়েন। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তিনি তিনটি বিয়ে করেছেন। বাংলাদেশে দুটি, পশ্চিমবঙ্গে একটি। তার প্রথম স্ত্রীর নাম লুসি। সেই ঘরে তার দুই সন্তান। দ্বিতীয় স্ত্রী সুইটির সঙ্গে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া এলাকার মেয়ে জামেলা খাতুন তার তৃতীয় স্ত্রী। তার সঙ্গেই তিনি রয়েছেন।

১৯৯৭ সালে নয়াপল্টনের একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম সুব্রতকে তার ১২ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেন। সুব্রত বাইন জেলে থাকার সময় তার স্ত্রী লুসির সঙ্গে তার গ্রুপের এক যুবকের প্রেম হয়। পরে সুব্রত বাইন জেল থেকে বেরিয়ে এসে লুসিকে নিজেই বিয়ে দেন ওই যুবকের সঙ্গে। সুব্রত বাইনের বাবা-মা টঙ্গীর নিজস্ব বাড়িতে থাকেন। ১৯৮৭ সালে মগবাজারকেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডে বিচরণ শুরু করেন সুব্রত বাইন। রফিক মার্ডার দিয়ে খুনাখুনিতে জড়ান। এরপর একে একে ট্রিপল, ডাবল মার্ডার। আন্ডারওয়ার্ল্ডে গ্যাং কিলিং জনপ্রিয় করে তোলেন অপরাধজগতের মুকুটহীন এই সম্রাট।

২০০০ সালের ১৮ মে পুরান ঢাকার জজ কোর্ট এলাকায় ফিল্মি কায়দায় খুন করা হয় হুমায়ুন কবির মিলন ওরফে মুরগি মিলনকে। এই খুনের পর সুব্রত বাইন দেশ ছেড়ে পালান। তিনি কলকাতায় আত্মগোপন করেন। মোহাম্মদ আলী ওরফে ফতেহ আলী নামে তিনি কলকাতার অপরাধীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বড় একটি চক্র। কলকাতার বালিগঞ্জে রয়েছে তার প্রাসাদোপম বাড়ি। সেখান থেকেই ১৩ লাখ রুপির জাল নোটসহ নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর কলকাতা পুলিশের হাতে প্রথম গ্রেপ্তার হন সুব্রত। তিনি সেখানে মোহাম্মদ আলী নাম পরিচয়ে চলতে থাকেন। কলকাতা থেকে জামিনে মুক্তি পান। কলকাতার মোহাম্মদ বাপি নামে এক ব্যক্তি তাকে সহায়তা করতে থাকেন। একটি ফুটবল টিমের কর্মকর্তা হয়ে তিনি সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন। এরপর চীন আর দুবাই গিয়ে ব্যবসা করেন। পরিচয় হয় দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে। দুবাই থেকে তারা যান নেপাল। কিন্তু তখনই ভারত সরকার তার নামে ইন্টারপোলে রেড নোটিস জারি করে। নেপালে আত্মগোপন করেন সুব্রত। ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সেখানে তিনি গ্রেপ্তার হন। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সুব্রত বাইন ১২ সহযোগীসহ নেপালের কারাগার থেকে সুড়ঙ্গ কেটে পালান। ২৭ নভেম্বর কলকাতা পুলিশের হাতে ফের গ্রেপ্তার হন। এর পর থেকে তাকে দেশে ফেরাতে ভারতের সঙ্গে একাধিকবার বাংলাদেশ চিঠি চালাচালি করে। কিন্তু ফেরত আনা যায়নি। তবে ২০২২ সালে তিনি বাংলাদেশে এসে আত্মগোপনে চলে যান।

‘কিলিং মেশিন’ মাসুদ

১৯৯৭ সালে রাজধানীর মিরপুরের চিড়িয়াখানা সংলগ্ন সড়কে মামুন নামে একজনকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন মাসুদ। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি পরিচিত মোল্লা মাসুদ নামে। অপরাধ জগতে ‘কিলিং মেশিন’ হিসেবে তাকে চিহ্নিত করা হয়। তিনি সুব্রত বাইনের সেকেন্ড ইন কমান্ড।

মাসুদের বাড়ি ঝালকাঠির মহাদেবপুর। তার বাবার নাম আমজাদ হোসেন। বাসা ঢাকার রমনার মীরবাগে। সুব্রত বাইনের মতো মোল্লা মাসুদের নামেও ইন্টারপোলে রেড নোটিশ রয়েছে।

বহু অপরাধ ও হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত মোল্লা মাসুদ ২০০৪ সালে ঢাকায় ক্রসফায়ারের ঘটনা বেড়ে গেলে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখান থেকেই মাসুদ বড় বড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে বিভিন্ন সময় মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে আসছিল। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা হুন্ডির মাধ্যমে চাঁদার টাকা তার কাছে পৌঁছে দিতেন।

কলকাতায়ও অপরাধে জড়ালে মোল্লা মাসুদকে গ্রেপ্তার করে সেখানকার সিআইডি। তখন দিল্লি থেকে বিষয়টি জেনে তাকে দেশে ফেরাতে উদ্যোগী হয় ঢাকার সরকার।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.