বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2025-08-03 12:59:39 BdST
কোটি কোটি টাকার টেন্ডারে ‘শুভংকরের ফাঁকি’
স্বাস্থ্য খাতে সরকারি কেনাকাটার অন্যতম সংস্থা কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) গত অর্থবছরে প্রায় ৬৫ কোটি টাকার ৩০টি চুক্তি সম্পাদন করেছে। এর মধ্যে ১২টি দরপত্রে (৪০ শতাংশ) অংশ নিয়েছে মাত্র একজন বৈধ দরদাতা। আরও কয়েকটি দরপত্রে প্রতিযোগী ছিল দুই বা তিনটি প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ একটি বড় অংশেই প্রকৃত প্রতিযোগিতার ঘাটতি ছিল স্পষ্ট।
বাংলাদেশ সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষের (বিপিপিএ) প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিপিপিএর এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংস্থাটির প্রায় অর্ধেক দরপত্রে (টেন্ডার) কার্যত কোনো প্রতিযোগিতাই ছিল না। এতে টেন্ডারের স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতামূলক মূল্য ও পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, একাধিক দরপত্রে পরিচিত একই সরবরাহকারীরা অংশ নিয়েছে এবং প্রস্তাবিত দাম অনেক ক্ষেত্রে অনুমানমূল্যের তুলনায় অনেক কম ছিল। কিছু ক্ষেত্রে এই পার্থক্য পৌঁছেছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। এসব টেন্ডারের মাধ্যমে কেনা হয়েছে মেডিক্যাল ফ্রিজ, রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি ও অ্যান্টি-রেট্রোভাইরাল ওষুধের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এইচআইভি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ কেনার জন্য এক কোটি ৪৮ লাখ টাকার টেন্ডার আহবান করে সিএমএসডি। কিন্তু দরপত্র জমা পড়ে মাত্র একটি—বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের। প্রতিষ্ঠানটি এই কাজ পায় অনুমানমূল্যের ১৬ শতাংশ কম দামে।
আইএমইডির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, এমন কম দাম ও মানহীন পণ্য সরবরাহের ইঙ্গিত দিতে পারে, আবার অন্যদিকে অনুমানমূল্য ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি ধরা হয়ে থাকতে পারে, যাতে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান সুবিধা পায়।
এমনকি কিছু টেন্ডার ছিল একেবারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন। যেমন—মোবাইল ক্লিনিক ভ্যান কেনার দরপত্র বারবার আহবান করলেও একজন ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। একই চিত্র দেখা গেছে মেথাডন, অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এবং কিছু উচ্চমূল্যের যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে।
প্রক্রিয়াগত ঘাটতি ও কাঠামোগত দুর্বলতা
প্রতিবেদনটি সিএমএসডির ভেতরের বেশ কিছু কাঠামোগত দুর্বলতাকে দায়ী করেছে। যেমন—প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনার অভাব, নিজস্ব কোনো দক্ষ ক্রয় সেল না থাকা, অল্পসংখ্যক পরিচিত সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরতা এবং চুক্তি বাস্তবায়নে ধীরগতি।
যদিও দরপত্র আহবান, মূল্যায়ন ও খোলার মতো প্রক্রিয়াগত দিকগুলো মানা হয়েছে, তবু চুক্তি অনুমোদন, নোটিশ ইস্যু এবং বিল পরিশোধে দেরি হয়েছে বলেও পর্যালোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে সিএমএসডি মোট ১৮টি বড় চুক্তি করেছে, যার আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৬১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। প্রতিযোগিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে সরকারি অর্থের সর্বোচ্চ সাশ্রয় নিশ্চিত করতে সিএমএসডির ক্রয়প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে বিপিপিএ।
তারা বলছে, সিএমএসডিতে একটি পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষ ‘প্রকিউরমেন্ট সেল’ গঠন করা জরুরি, যেখানে শুধু নিয়ম মানলেই হবে না, থাকবে পরিকল্পিত ও পেশাদার ব্যবস্থাপনার ছাপ।
তারা বলছে, যেসব কর্মকর্তা সরাসরি টেকনিক্যাল দায়িত্বে নেই, তাঁরাও যেন ক্রয়প্রক্রিয়া বুঝে তা কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারেন, এজন্য তাঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।
অর্থবছরের শুরুতেই পুরো বছরের বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (অ্যানুয়াল প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান) তৈরি করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, যাতে টেন্ডার আহ্বানে পরিকল্পনাহীনতা ও দেরি এড়ানো যায়। পরিকল্পনায় সময়সীমা নির্ধারণ করে অগ্রাধিকারভিত্তিক তালিকা তৈরি করার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
ক্রয়ে যেন অল্প কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি না হয়, সে জন্য নতুন ও বৈচিত্র্যময় সরবরাহকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। দরপত্র আহবান ও মূল্যায়নের পর চুক্তি সম্পাদনে যাতে দেরি না হয় এবং সময়মতো বিল পরিশোধ করা হয়, সেদিকেও নজর দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.