September 20, 2025, 2:41 pm


কূটনৈতিক প্রতিবেদক

Published:
2025-09-20 12:43:52 BdST

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তোলপাড়সনি হত্যা মামলার আসামীরা এখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রভাবশালী কনসাল জেনারেল


বুয়েট শিক্ষার্থী সাবিহা ইকবাল সনি হত্যা মামলার প্রাথমিক অভিযোগপত্রের দুই আসামী এখন যুক্তরাষ্ট্র্রের দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল। মোজাম্মেল হক পিটারকে নিউইয়র্কে এবং কাজী জাবেদ ইকবালকে লস অ্যাঞ্জেলেসে কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তীব্র বিতর্ক ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা কেবল হত্যা মামলার অভিযোগপত্র থেকে নিজেদের নাম বাদ দেননি, পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েও ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও নজিরবিহীন দলীয়করণ চালিয়ে গেছেন। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর এই দুই কর্মকর্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাগ্যবিধাতা হয়ে উঠেছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মোজাম্মেল হক পিটার ও কাজী জাবেদ ইকবাল দুজনই বুয়েটে অধ্যয়নকালে ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ক্যাডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০০২ সালের ৮ জুন বুয়েট ক্যাম্পাসে টেন্ডারবাজিকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সশস্ত্র সংঘর্ষে নিহত হন মেধাবী শিক্ষার্থী সনি। এই সংঘর্ষে পিটার ও জাবেদ সরাসরি লিপ্ত ছিলেন এবং হত্যা মামলার প্রাথমিক চার্জশিটে তাদের নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তৎকালীন বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী ও তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের প্রভাব খাটিয়ে তারা দুজনই চার্জশিট থেকে নিজেদের নাম বাদ দিতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তারা হাওয়া ভবনের প্রভাব ব্যবহার করে বিসিএস পরীক্ষার নির্ধারিত কেন্দ্রে পরীক্ষা না দিয়ে বুয়েটের রশিদ হলে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় পরীক্ষা দেন এবং পররাষ্ট্র ক্যাডারে নিয়োগ পান।

পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগদানের পর থেকেই এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দলীয়করণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। তারা সরাসরি বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতেন, যা সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সরকার পরিবর্তনের পরও তাদের এই কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, মোজাম্মেল হক পিটার বিদেশে পোস্টিংয়ে থাকলেও ঢাকার রাজনীতি ও টেন্ডারবাজির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অন্যদিকে, কাজী জাবেদ ইকবাল কাতার ও চীনে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত থাকাকালে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাকে দেশে ফেরত আনা হয়।

৫ আগস্টের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা উপদেষ্টাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করে পিটার ও জাবেদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন। তাদের ইচ্ছাতেই এখন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং ও পদায়ন হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সচিব তাদের চাপে অসহায় বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কর্মকর্তাদের ‘ট্যাগিং’ করে বদলির জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছেন।

অনেক সিনিয়র ও যোগ্য কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে মোজাম্মেল হক পিটারকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সম্প্রতি তার প্ররোচনাতেই নিউইয়র্ক কনস্যুলেটে একজন উপদেষ্টাকে স্থানীয় বিএনপি কর্মীদের দ্বারা হেনস্থা হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। নিউইয়র্কে থেকেও তিনি ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পোস্টিং ও পদায়ন বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে মোজাম্মেল হক পিটারের নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু সনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসতে পারে, এই আশঙ্কায় শেষ মুহূর্তে তাকে আর ঐ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এর বিকল্প হিসেবে তাকে নিউইয়র্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কনসাল জেনারেল করে পাঠানো হয়।

অন্যদিকে, কাজী জাবেদ ইকবালও সিনিয়রদের ডিঙিয়ে জার্মানি থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে কনসাল জেনারেলের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পোস্টিং নীতিমালা অনুযায়ী, জার্মানি (ক গ্রুপ) থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস (ক গ্রুপ) পোস্টিং আইনসিদ্ধ নয়। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এই নিয়োগ নিশ্চিত করেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে, এই দুই কর্মকর্তার দৌরাত্ম্যে মন্ত্রণালয়ে চেইন অফ কমান্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। তাদের কারণে সিনিয়র ও পেশাদার কূটনীতিকদের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। সনি হত্যা মামলার আসামীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ এবং তাদের দ্বারা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.