November 15, 2025, 12:40 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-11-14 16:29:06 BdST

মাগুরার নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ অনিয়ম


মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নিয়োগ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত দল।

সম্প্রতি শিক্ষা অধিদপ্তরে দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক ও বর্তমান প্রধান শিক্ষকসহ গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য যোগসাজশে বিদ্যালয়ের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সাবেক প্রধান শিক্ষক এ. এস. এম. রফিকুল আলা, সাবেক গভর্নিং বডির সভাপতি হুমাইনুর রশিদ মুহিত, সদস্য সুব্রত বিশ্বাস পারস্পরিক যোগসাজসে একাধিক খাত থেকে প্রায় ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

অন্যদিকে, বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক শেখ আ. মান্নানের বিরুদ্ধে প্রায় ২৯ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে।

তদন্তকারী দলের ভাষায়, “বিদ্যালয়টির আর্থিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে একটি সংগঠিত চক্র ছিলো যারা এই আর্থিক অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত ও সক্রিয় ছিল।”

পতিত সরকারের আমলে এই চক্রের সদস্যরা বিদ্যালয়ে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। তাদের নিকট বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী এবং অভিভাবকরা জিম্মি ছিলেন। ভেঙে পড়েছিল বিদ্যালয়ের নিয়মনীতি সহ সব ধরনের অবকাঠামো।

৫ আগষ্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের নবগঠিত এডহক কমিটির সভাপতি, বিশিষ্ট আয়কর উপদেষ্টা মির্জা ওয়ালিদ হোসেন শিপনের অনুমোদিত অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির তদন্তে সর্বপ্রথমে এই অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের চিত্র প্রকাশ পায়।

বিদ্যালয়টি ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধান শিক্ষক এ এস এম রফিকুল আলা ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়কালে এবং পূর্ববর্তী ছয় বছরেও কোনো অডিট না হওয়ায় তার ও সাবেক সভাপতির যোগসাজশে প্রায় ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট প্রতিয়মান।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রধান শিক্ষক শেখ আ. মান্নানের নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায়ই সাবেক সভাপতি হুমায়ুন রশিদ মুহিত নতুন গভর্নিং বডি গঠন করে তাকে নিয়োগ দেন, যা স্পষ্টতই বিধিবহির্ভূত। একইভাবে সহকারী শিক্ষিকা সুবর্ণা জামানকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রেও নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়।

আর্থিক খাতে ব্যাপক গরমিল

তদন্তে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের বিভিন্ন তহবিল থেকে অন্তত আরও ৩৪ লাখ ৬১ হাজার ৪৫২ টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় বা আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে রেকর্ডপত্র ও ভাউচার গায়েব থাকায় তদন্ত দল মনে করছে, প্রকৃত অনিয়মের পরিমাণ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে।

এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাবেক প্রধান শিক্ষক রফিকুল আলা অবসরের ঠিক আগে ২৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র গায়েব করে দেন। অবসর নেওয়ার সময় তিনি পরবর্তী প্রধান শিক্ষকের কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়–ব্যয়ের কোন দলিল হস্তান্তর করেননি। তার মেয়াদে রেজুলেশন ছাড়াই ব্যাংক থেকে ৫১ লাখ টাকা উত্তোলন করে সাবেক সভাপতি হুমায়ুন রশিদ মুহিতের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তরের ঘটনাও তদন্তে উঠে এসেছে।

এছাড়া শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির ১ লাখ ৪ হাজার টাকা বিতরণ ছাড়াই তোলা হয়। দোকান ভাড়া বাবদ ৬৩ হাজার ৯০০ টাকা এবং সাধারণ তহবিলের ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা –এরও কোনো হিসাব মেলেনি। এমনকি বিদ্যালয়ের ক্যাশ বহিতেও একাধিক জায়গায় অঙ্কের গরমিল পাওয়া গেছে।

আলোচিত এই তদন্ত কমিটির সদস্য শিক্ষা পরিদর্শক মো. জহিরুল ইসলাম ও অডিট কর্মকর্তা চন্দন কুমার দে প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছেন। তাঁরা বিদ্যালয়ের সব আর্থিক রেকর্ড দ্রুত উদ্ধার ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের ওপর জোর দিয়েছেন।

গত ১২ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক প্রফেসর এম এম সহিদুল ইসলাম তদন্ত প্রতিবেদনটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রেরণ করেন।

স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকেরা বলছেন, “প্রধান শিক্ষক আর সভাপতির যোগসাজশ ছাড়া এমন দুর্নীতি সম্ভব না।”

তাদের দাবি, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘটা ন্যাকারজনক এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন অনিয়মের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.