December 30, 2025, 10:00 pm


S M Fatin Shadab

Published:
2025-12-30 20:07:57 BdST

সারা বিশ্বে ইতিহাস গৃহবধু থেকে প্রধানমন্ত্রী


সারা বিশ্বে ইতিহাস গৃহবধু থেকে প্রধানমন্ত্রী
সালাহউদ্দিন মিঠু
-------------------------
একজন মহীয়সী মানবী বেগম খালেদা জিয়া সারা বিশ্বে যার পরিচিতি আপোষহীন দেশনেত্রী। জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার ভোর ছয়টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
খালেদা জিয়া বিধবা হন ৩৬ বছর বয়সে। তখন তিনি একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান-দুই সন্তান নিয়েই ছিল তাঁর সংসার।
তার পুরো নাম ছিল খালেদা খানম। আর পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে তাঁর ডাক নাম ছিল পুতুল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া এক অনন্য নাম। তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্বদাতা এবং দীর্ঘ সময় ধরে বিরোধী রাজনীতির দৃঢ় প্রতীক তিনি। অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্ম নেওয়া একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যা ‘পুতুল’ সময়ের পরিক্রমায় পরিণত হন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও আলোচিত রাষ্ট্রপ্রধান।
১৯৮১ সালের মে মাসে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, খালেদা জিয়া তখন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। রাজনীতি নিয়ে চিন্তাধারা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক কোনো অনুষ্ঠানেও তাকে খুব একটা দেখা যেত না। সময়ের পরিক্রমায় তিনি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে গৃহবধূ থেকে হয়েছেন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী।
ঘরে-বাইরে নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তাকে দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। স্বামী হারানোর বেদনার মধ্যে বিএনপির হাল ধরতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। সেখানেও অনেক প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয় তাকে। শুরু হয় রাজনৈতিক সংগ্রামের জীবন। টানা আট বছর রাজপথে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন খালেদা জিয়া। একসময় পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। কখনো আপস করেননি বলে তাকে আপসহীন নেত্রীর উপাধি দেওয়া হয়। দৃঢ় মনোবলের কারণে, দেশপ্রেমের কারণে, গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে দেশের মানুষ তাকে ছেড়ে যায়নি। নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতনের পর ভঙ্গুর বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেন, জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, সবগুলোতেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। মুসলিম বিশ্বে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও ইতিহাসের পাতায় রয়েছে খালেদা জিয়ার নাম। 
খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালে। বাবা ফেনীর পরশুরামের ইস্কান্দার মজুমদার ছিলেন ব্যবসায়ী। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে খালেদা তৃতীয়। ছোটবেলায় তার ডাক নাম ছিল পুতুল। ইস্কান্দার মজুমদার ব্যবসার উন্নতির জন্য যান দিনাজপুরে। ১৯৪৭ সালের পর তিনি দিনাজপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৩৭ সালের ১৯ মার্চ তার বিয়ে হয় পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার তৈয়বা মজুমদারের সঙ্গে। 
জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে দিনাজপুরে থাকার সময় খালেদার সঙ্গে বিয়ে হয়। ১৯৬০ সালের ৫ আগস্ট দিনাজপুরের মুদিপাড়ায় খালেদার বাবার বাড়িতে বিয়ের আয়োজন হয়। খালেদা জিয়ার শ্বশুর তখন বিয়ের অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি, কারণ তিনি করাচিতে ছিলেন। খালেদার মা ছিলেন জিয়াউর রহমানের মায়ের দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) যোগ দেন।
১৯৮৩ সালে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন এবং ১৯৮৪ সালের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ–এর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে টানা আন্দোলনে নেতৃত্বের সময় একাধিকবার গৃহবন্দি, সভা-সমাবেশে বাধা, মামলা ও নিপীড়নের শিকার হন খালেদা জিয়া। আন্দোলনের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে যৌথভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সেই সরকারে সময়ই সংসদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী শাসিত বা ‘সংসদীয় পদ্ধতির’ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়।
তার শাসনকালেই তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত হয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামীলীগের বর্জনের মুখে নির্বাচন করে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন খালেদা জিয়া।
পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে বিরোধী দলের আসনে বসেন। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন নানা ইস্যুতে। ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন হলে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে চার দলীয় জোট জয়ী হয়। যে জোটে শরিক ছিল জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্য জোট।
২০০১–২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের সময় দেশের অর্থনীতি ও অবকাঠামো খাতে কিছু অগ্রগতি হয়েছিলো। তবে জঙ্গিবাদের উত্থান ও রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে সমালোচনা হয়। রাজনৈতিক তীব্র সংকটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে খালেদা জিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্যে রাষ্ট্রপতিই সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন।
এরপর ২০০৭–২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে গ্রেপ্তার হন তিনি।
মুক্তি পেয়ে ২০০৮ এর নির্বাচনে তার দল অংশ নিলে কম আসনে জয়ী হয়ে আবার বিরোধী দলের আসনে বসেন। ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড হয় তার।পরবর্তীতে গুরুতর অসুস্থতার কারণে শর্তসাপেক্ষ জেল থেকে বাসায় থাকার অনুমতি পান।তবে তাকে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে দেয়া হয়নি। ২০২৪ এর ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর মুক্তি পেয়ে দেশবাসীর প্রতি শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘদিন একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দেয়া উপমহাদেশের একটি বড় ঘটনা। তার দীর্ঘ জীবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব—“দুই নারীর লড়াই” হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বে পরিচিতি পায়।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক ধারাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘আপসহীন নেত্রী’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়া সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনো হারেননি।

১৯৯১ সালের ১৯ মার্চ বেগম খালেদা জিয়া পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার সরকার দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। ২ এপ্রিল তিনি সংসদে সরকারের পক্ষে এই বিল উত্থাপন করেন। একই দিন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে স্বপদে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে একাদশ সংশোধনী বিল আনেন।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। খালেদা জিয়া এই সংসদেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর এই সংসদের মেয়াদ শেষ হয়।
বেগম খালেদা জিয়া। তিনি বাংলাদেশের এক গৃহবধূ থেকে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন তিনি। গৃহবধূ থেকে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠার এই যাত্রা ছিল নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের ইতিহাস।
২০১১ সালের ২৪ মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ পদক প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোনো বিদেশিকে এ ধরনের সম্মান প্রদানের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সম্মাননা দেয় কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) নামের একটি সংগঠন।
২০০৬ সালে তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্বাসনে পাঠানোর একাধিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দুর্নীতির তুচ্ছ এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে স্বৈরাচারী সরকার গ্রেপ্তার করে।
তিনি ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনগুলোতে পাঁচটি পৃথক সংসদীয় আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি যে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সেখানে তিনি সব ক'টিতে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন।
২০০৯ সাল থেকে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার নির্বিচারে গুম, খুন, ক্রসফায়ার আর বিনাবিচারে ভিন্নমতের রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র থেকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করে, তখন তিনি গণতন্ত্রের জন্য তার লড়াই নতুন করে শুরু করেছিলেন। সরকার তাকে জোরপূর্বক তার বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দেয় এবং গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন শুরু করায় তাকে দুইবার গৃহবন্দী করা হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২০ সালের কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিস প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইন বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে যে, মূলত নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি রাজনৈতিক চক্রান্ত হিসেবেই তাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে যে তার ‘ন্যায্য বিচারের অধিকারকে সম্মান করা হচ্ছে না।’
বাংলাদেশের রাজনীতির সব উত্তাল সময়ে খালেদা জিয়া ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। স্বাধীনতার পরবর্তী রাষ্ট্রগঠনের রাজনীতি, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, গণতন্ত্রের চড়াই-উতরাই—সবকিছুরই এক অপরিহার্য অংশ তিনি।
তার জীবন ইতিহাসের কাছে একদিকে সংগ্রামী নারীর উঠে দাঁড়ানো, অন্যদিকে ক্ষমতার রাজনীতির বিচিত্র অধ্যায়; যেখানে রয়েছে সাফল্য, ব্যথা আর অনমনীয় জেদ—সব মিলেই ‘খালেদা জিয়া’ নামটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিধানে এক স্থায়ী রেখা এঁকে রেখেছে।
'দেশনেত্রী’ , ‘আপসহীন’ উপাধিতে ভূষিত খালেদা জিয়া চিরবিদায় নিলেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.