April 29, 2024, 7:27 am


ভারতী মিশ্র নাথ

Published:
2024-01-12 13:38:44 BdST

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জয় ভারতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ?


বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ বিজয় এবং পঞ্চমবারের মত প্রধানমন্ত্রীত্ব লাভ করা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি গত ১১ জানুয়ারি সিনিয়র সাংবাদিক ভারতী মিশ্রা নাথের একটি লেখা প্রকাশ করেছে।

পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে লেখাটির হুবুহ অনুবাদ তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো জয়লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি শেখ হাসিনার পঞ্চম বিজয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এই নির্বাচন বয়কট করেছে। এর আগে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানায় দলটি।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক হারে কম ভোটার উপস্থিতির ব্যাপারটিও বেশ বিতর্কিত হয়েছে। সরকারী পরিসংখ্যান মতে, ভোটার উপস্থিতি ৪০ শতাংশ হলেও বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে এটি ২৮ শতাংশেরও কম হতে পারে।

এর সত্যতা মেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার করা একটি স্ক্রিনশট অনুসারে। ওই স্ক্রিনশটে দেখা গেছে প্রেস ব্রিফিংয়ের কয়েক ঘন্টা পরে নির্বাচনী সংস্থার সদর দফতরে ড্যাশবোর্ডে ভোটার উপস্থিতি ছিল ২৮ শতাংশ। এই নির্বাচনকে 'ডামি ভোট' বলে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি।

যদিও ভোটের দিন শান্তিপূর্ণভাবে কেটেছে, কিন্তু নির্বাচনের এই দৌড়ে ব্যাপক সহিংস বিক্ষোভ এবং মারাত্মক অগ্নিসংযোগের ঘটনাও দেখা গেছে। সরকারের অভিযোগ, বিএনপি এই নির্বাচনে নাশকতার জন্য এই সকল সহিংসতা উসকে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও অনেক দেশ অভিযোগ করেছে যে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি এবং অনিয়মে পরিপূর্ণ ছিল। কোনো বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনার দলের এই একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে সমালোচকরাও নানাভাবে সতর্ক করেছেন।

এদিকে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এ সকল অবস্থানের ব্যাপারে বলতে গেলে বাংলা ইনসাইডারের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ বোরহান কবির বলেছেন, ‘বিএনপির নির্বাচন থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত তাদের দলের কৌশলগত পছন্দ। গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপি রাজনৈতিক সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগে জড়িত। একটি গণতান্ত্রিক সরকার এসব দেখে শুধু বসে থাকতে পারে না। জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। এই ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া সরকারের কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।‘

তিনি আরও বলেন, ‘এটা সত্যি যে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলে গণতন্ত্র পরিপূর্ণ হতো এবং নির্বাচনও প্রতিযোগিতামূলক হতো। এরকম পরিস্থিতিতে ভোটার উপস্থিতি সবসময়ই কম থাকে, এটাই স্বাভাবিক। তবুও, ৪১ শতাংশ ভোটার তাদের ভোট দিয়েছেন, যা একেবারে খারাপ না। একটি অসাংবিধানিক সরকারের চেয়ে একটি দুর্বল সাংবিধানিক সরকার অনেক ভালো।‘

ভারত-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকাকে সর্বদাই স্বীকার করে এসেছে। দুই দেশের মধ্যে এক অভিন্ন ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধন দেখা যায়।

দু’দেশের মধ্যে একটি অনন্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশ কেবলমাত্র চারদিক থেকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত নয়, দুই দেশ নিজেদের মধ্যে ৫৪টি নদীও ভাগ করে নিয়েছে, যা হিমালয় থেকে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। এতসব মিলের মধ্যে দু’দেশের জনগণের মধ্যকার বন্ধন এবং উন্নয়ন সহযোগিতা সবসময়ই প্রাধান্য পায়।

তবুও, এমন অনেক সময় এসেছে যখন দুই দেশের ভেতর পারস্পরিক অবিশ্বাসও দেখা গেছে।

সৈয়দ বোরহান কবির ব্যাখ্যা করে বলেন যে ১৯৭৫ সালের পর ভারত বিরোধী মনোভাব এবং বাংলাদেশ কিছুটা পাকিস্তানকেন্দ্রিক রাজনীতির দিকে পরিবর্তিত হয়। যে কারণে দুই দেশের মধ্যে তখন একটি টানাপোড়েনের সম্পর্ক ছিল এবং কখনও কখনও ভারতকে লক্ষ্য করার জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডও ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ‘২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো-টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেন। আর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থান ভারতের কাঙ্খিত কিছু নয়।‘ একইসঙ্গে, গত ১৫ বছরে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাও জোরদার হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সেপ্টেম্বর ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা থাকা তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ব্যর্থ চুক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। এছাড়া প্রস্তাবিত ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন এবং সিটিজেনশিপ (সংশোধন) আইনের আন্তঃসীমান্ত প্রভাব নিয়েও বাংলাদেশে উদ্বেগ রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত ঘটনাগুলি, যেমন- সীমান্তে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের গুলি করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের সাথে বিরোধপূর্ণ বিষয়।

অর্থনৈতিক দিক থেকে, বাণিজ্যের ভারসাম্য ভারতের পক্ষেই বেশি ভাগ হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বৃহৎ পরিমাণে অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য, আবার ভারতের আধিপত্যের ফলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে বাংলাদেশে। আর এসবের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আশা করছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার এই বিষয়গুলো সমাধান করবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এপ্রিল থেকে অক্টোবর ২০২৩ এর মধ্যে বাংলাদেশে ভারতীয় রপ্তানি ১৩.৩২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। যেখানে আমদানি ২.৩ শতাংশ কম হয়েছে। আর এর জন্য দায়ী করা হয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি এবং তারল্য সংকট এবং সম্ভবত নির্বাচন-সংক্রান্ত মন্দা।

দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্বের শক্তিশালী গতির দিকে তাকিয়ে থাকা ভারতের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জয়ের চেয়ে ভালো খবর আর হতে পারে না। নানা বিষয়ে উদ্বেগ দূর করতে, ভারত ও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং আঞ্চলিক সংযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আলোচনা করেছে। গত নভেম্বরে তিস্তা নদী বিরোধ ও অন্যান্য পানি বণ্টন চুক্তি নিয়েও দুই পক্ষ আলোচনা করেছে।

ভারত যে বাংলাদেশকে অনেকখানি মূল্য দেয় সেটি প্রমাণিত হয়েছিল যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সভাপতিত্বে জি২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রিত দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নেতা ছিলেন।

সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য, প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং শেখ হাসিনা সম্প্রতি তিনটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন। যেগুলো হলো- আখাউড়া-আগরতলা ক্রস-বর্ডার রেল লিঙ্ক, খুলনা-মংলা পোর্ট রেল লাইন এবং বাংলাদেশের রামপালে মৈত্রী সুপার ক্রিটিক্যাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-২।

এই প্রকল্পগুলির লক্ষ্য এই অঞ্চলের মধ্যকার সংযোগ এবং শক্তি নিরাপত্তা জোরদার করা। বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর হয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পণ্য পরিবহন ও ট্রান্স-শিপমেন্টের অনুমতি দিয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। সিইপিএ (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট) এর অধীনে, দুটি ব্যবসায়িক অংশীদার তাদের মধ্যে ব্যবসা করা সর্বাধিক সংখ্যক পণ্যের উপর শুল্ক কমাতে বা বাদ দিতে সক্ষম হবে। এছাড়া গত বছর, ভারত ও বাংলাদেশ মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং আঞ্চলিক মুদ্রা বাণিজ্যকে শক্তিশালী করতে রুপিতে বাণিজ্য লেনদেন শুরু করেছিল।

জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, ‘দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক অন্যরকম উচ্চতায় রয়েছে। স্বল্পমেয়াদে, স্বাভাবিক হিসাবে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা হবে তবে দীর্ঘমেয়াদে, যদি কোনও সুনির্দিষ্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত না হয় তবে জনগণ যা বোঝার বুঝে নেবে। সাধারণ মানুষের জন্য পানির ভাগাভাগি সবসময়ই একটি আবেগপূর্ণ বিষয় ছিল দেশটির জন্য।‘

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ মনে করে যে তারা তাদের বাণিজ্য করিডোর খোলার জন্য এবং আন্তঃসীমান্ত দ্বিপাক্ষিক সম্পৃক্ততার সুবিধার্থে ভারতকে সমর্থন করেছে। আর ভারতের বাংলাদেশকে প্রতিদান দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।‘

ভারত ও বাংলাদেশের টিকে থাকার জন্য একে অপরের প্রয়োজন। মৌলবাদ দু’দেশের জন্যই একটি সাধারণ শত্রু এবং শুধুমাত্র যৌথ লড়াই-ই পারবে এটিকে দমনে দু’দেশকে সাহায্য করতে। ভূ-রাজনীতির বিষয়গুলি পারস্পরিকভাবে দু’দেশের জন্যই উপকারী এবং সম্পর্ক স্থাপনকারী দেশগুলির দিকেই এটি নির্দেশ করে। এর জন্য কোনো গাইডলাইন নেই। দেশগুলির উচিত অংশীদারিত্ব স্থাপন করা যা জড়িত সকল পক্ষকে উপকৃত করে এবং দু’দেশের ভাগ করা স্বার্থ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য সহযোগিতা বৃদ্ধি করে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from Spot Light