April 27, 2025, 4:27 pm


নেহাল আহমেদ

Published:
2025-04-08 13:43:03 BdST

পাঁঠার অভাবে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে ছাগল উৎপাদন


আমাদের সমাজে অনেক ট্যাবু কাজ করে। এখানে নিজ স্ত্রীকে একটু হাত ধরলে অসামাজিক মনে করা হয়। অথচ স্ত্রীকে বকাঝকা করা, প্রহার করা স্বাভাবিক মনে করা হয়। এই সব অন্তর্নিহিত নিষেধ বা ধর্মীয় অথবা সামাজিক বেড়াজাল অতিক্রম বা কোনো কিছুর বিরুদ্ধে নিরুৎসাহিত সাংস্কৃতিক অনুভূতি, যা খুবই বিপদজনক বা বীভৎস, বা সম্ভবত সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত পবিত্র বা অপবিত্র বিবেচনাবোধ। কার্যত সকল সমাজে এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা বর্তমান রয়েছে, রাষ্ট্র এবং সমাজভেদে ট্যাবুর ভিন্নতা দেখা যায়।

ছাগল পালন এবং এর প্রজনন একটি স্বাভাবিক বিষয়। একটা সময় এটি স্বাভাবিক প্রকৃতির নিয়মেই হয়ে থাকতো। সময়ের চাহিদায় গরু ছাগল পালনের প্রয়োজনে, প্রজননের প্রয়োজনে পাঠা পালন আবশ্যিক হয়ে পড়ে।

আজ থেকে কয়েক বছর আগেও দেখা যেত গ্রামের অসহায়, বিধবা নারী পাঠা পালন করতো। ধর্মীয় ট্যাবু এবং সমাজের অবজ্ঞায় এদের হেয় মনে করা হত। দিন দিন এটাকে পেশা হিসাবে নিয়েছে কিছু পরিবার। এই পেশায় ব্যক্তি এবং পরিবার নানান সামাজিক সমম্যায় সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি কথা হয় রাজবাড়ী জেলার ড্রাই আইস ফ্যাক্টরি এলাকার বাচ্চু শেখের সাথে। তিনি দেশী বিদেশী কয়েকটি পাঠা ক্রয় করে প্রজনন খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি জানান, তার দুই মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত। তার পেশার কথা শুনে কেউ তার মেয়েদের বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না।

শখের বশে ছাগল পালন শুরু করেছিলেন রাজবাড়ী জেলার লক্ষীপুর গ্রামের হারেছা বেগম। ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন একটি খামার, বর্তমানে যেখানে ২০টি ছাগল রয়েছে। সেখানে কোনো পাঁঠা না থাকায় প্রজননের সময় ছাগলকে প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার দূরের অন্য একটি গ্রামে নিয়ে যেতে হয়। এতে ছাগলপ্রতি পরিবহন খরচসহ গুনতে হয় এক হাজার টাকা।

এমন নানান সংকটে প্রায় অর্ধেক ছাগলেরই প্রজননের সময় পার হয়ে যায়। আবার যেসব পাঁঠা পাওয়া যায় সেগুলোও ভালো জাতের নয়। অতি সংকরায়নের ফলে খামারের ছাগলগুলো এখন কোন জাতের তা বলা মুশকিল। আগের চেয়ে বেড়েছে রোগ-বালাইও।

শুধু হারেছা বেগমই নন, প্রায় সব জেলার ছাগল পালনকারীরাই এই সংকটে রয়েছেন। এদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাগল পালনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে পাঁঠা সংকট। সামাজিক ও ধর্মীয় ভুল ধারণার কারণে মূলত খামারিরা পাঁঠা পালন করতে চান না। আবার চাহিদা বেশি থাকায় মর্দা ছাগলকে জন্মের কয়েক দিন পরই খাসি করিয়ে দেয়া হয়। সামাজিক অবজ্ঞা আর নানা কটুকথা উপেক্ষা করে কেউ কেউ পাঁঠা পালন করলেও এগুলোর বেশিরভাগই নিম্নমানের। তারপরও বিকল্প না থাকায় অনেক দূর-দূরান্ত থেকে এসব পাঁঠার কাছেই ছাগল নিয়ে ছুটতে হয় খামারিদের।

ছাগল উৎপাদনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দেশে গুণগত মানসম্পন্ন ও অধিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁঠা তৈরির কোনো উদ্যোগ নেই। বছরে বছরে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পাঁঠার জাত উন্নয়ন করতে হয়। কিন্তু এই বিষয়েও সরকারি-বেসরকারি কোনো কার্যক্রম দেশে নেই।

দ্বিতীয় সমস্যা হলো এক পাঁঠা দিয়ে যদি কোনো বাড়িতে বা এলাকায় এক বছরের বেশি প্রজনন করানো হয় তাহলে ইনব্রিডিং (অন্তঃপ্রজনন) হয়। অর্থাৎ রক্তের সম্পর্কের মধ্যে প্রজননের ফলে যে বাচ্চা জন্ম নিচ্ছে সেটাই ইনব্রিডিং। এতে বাচ্চার মৃত্যুহার বেড়ে যায়।

তথ্যে পাওয়া সূত্র জানায় ‘সংখ্যা কমে আসায় এখন খামারিরা একই পাঁঠা দিয়ে সব ছাগলকে প্রজনন করাচ্ছেন। এতে অন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে জন্ম নেয়া ছাগল রোগাক্রান্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে মাংস উৎপাদন কমে আসার পাশাপাশি ধীরে ধীরে জাতও অনুন্নত হতে থাকে।’

দেশে ছাগলের সিমেন উৎপাদনকারী একমাত্র বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। ২০০০ সালের পর থেকে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন করছে সংস্থাটি। বছরে তারা ৭০-৮০ হাজার ডোজ সিমেন উৎপাদন করে। তাদের এখন প্রজনন সক্ষম পাঁঠা রয়েছে ২৫টির মতো। এক্ষেত্রে সফলতার হার ৫৫-৬০ শতাংশ।

কৃত্রিম প্রজননসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গরুর ক্ষেত্রে কৃত্রিম প্রজনন লাভজনক হলেও ছাগলের ক্ষেত্রে তা এখনো লাভজনক হয়ে ওঠেনি। ফলে এতে আগ্রহ দেখান না প্রজননকর্মীরা।

দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের প্রধান চালিকাশক্তি নারী। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের শ্রমে ভর করেই এগোচ্ছে এই খাত। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৮৮ দশমিক ২ ও পুরুষের কেবল ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে নারীদের বড় একটি অংশ ছোট পরিসরে ছাগল লালন-পালন করে থাকেন। তবে প্রজননের জন্য ভালো পাঁঠা না পাওয়ায় অনেকেই খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন।

ছাগল খামারিদের অনেকেই জানান, সামাজিক অবজ্ঞার কারণে পাঁঠা পালন করতে পারেন না তারা। এই বিষয়ে রামকান্তপুর গ্রামের আবুল মিয়া বলেন, ‘বহুকাল আগ থেকে এই অঞ্চলে ছাগল ডাকে (প্রজনন সময়) এলে চা বাগানের পাঁঠার কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রচলন। স্থানীয়ভাবে কেউ পাঁঠা পালন করে না। আবার যারা পালন করেন তাদের নিচু জাত বলে অবজ্ঞা করা হয়। তাছাড়া এর মাংস খাওয়ার প্রচলন কম থাকায় বাজারে দাম পাওয়া যায় না। এই কারণেও কেউ পাঁঠা পালন করেন না।’

দেশে ভালো জাতের পাঁঠার খুব সংকট। সরকারিভাবে যা পাওয়া যায় সেটাও অপ্রতুল। এটাকে আরো বিস্তৃত করা উচিত। এছাড়া মানুষের মাঝে ছাগল পালনকে উৎসাহ দিতে হলে পাঁঠা পালনকেও উৎসাহ দিতে হবে। তবে যারা পাঁঠা পালন করবেন তাদের আইনি কাঠামোয় আনতে হবে, যেন নিয়মতান্ত্রিক প্রজনন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ছাগলের জাত উন্নয়ন করা হবে এবং তাদের সিমেন সংগ্রহ করে কৃত্রিম প্রজনন করা হবে দরকার বলে মনে করেন ছাগল খামারীরা।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.