May 8, 2025, 4:42 pm


নেহাল আহমেদ

Published:
2025-05-08 11:05:03 BdST

আমার রবীন্দ্রনাথ


এই শহরে রবীন্দ্রনাথ কার হাত ধরে এসেছেন জানিনা কিংবা কবে এসেছেন তাও জানিনা। তবে উনি যে এই শহরে আছেন তার প্রমান আমি পেয়েছি। হয়তো কোন বিদ্যালয়ে কিংবা কলেজে নিশ্চয় তাকে নিয়ে কথা হতো কিংবা রেডিওতে তার গান শোনা যেত। আমাদের পাড়ায় তখন হিন্দুদের বসবাস ছিল চোখে পড়ার মত।কোন কোন বাড়ীতে গানের চর্চা হতো। সেখানে নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতো।

মুসলমানদের জন্য গান হারাম, ছবি আকাঁ হারাম। আর রবীন্দ্রনাথ তো হিন্দু। এক সময় এই জন্যই এই দেশে রবীন্দ্রচর্চা হয়তো নিষিদ্ধ ছিল। এক সময় রবীন্দ্রনাথ ছিল আভিজাতেরর ঘরে। রবীন্দ্রনাথকে বোঝা বা জানার চর্চা তেমন ছিল না হয়তো। সে সব হয়তো অনেকদিন আগের কথা। আমার রবীন্দ্রনাথ, জ্ঞানের আলো জ্বেলে পৃথিবীকে এক শান্তির অভয়ারণ্য গড়তে তাঁর সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন।

আজো অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে ঠিক ভাবে উপস্থাপন করেন না। নানা কায়দায় নানা ভাবে তাকে কখনো সাম্প্রদায়িক, কখনো হিন্দু, নানান যুক্তিতে হেয় করতে তৎপর।

যখন দেখি একটি শিক্ষিত সমাজও রবীন্দ্রনাথকে হেয় করছে তখন সত্যিই মনে হয় আমাকে শিক্ষিত করেছো মানুষ করনি। রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষদের জন্য কতটুকু করতে পেরেছেন জানি না, তবে চেষ্টা করেছিলেন। যে চেষ্টা খুব কম মানুষই করেছেন। চেষ্টা করেছিলেন বলেই, ইংল্যান্ড ও কলকাতার আয়েশী জীবন ছেড়ে কুষ্টিয়ার এক অবহেলিত গ্রামে বাস করেছেন। কাদা-মাটি আর মশা-মাছিতে ভরা অঞ্চলে স্বপ্নের বীজ বপন করেছেন। উনার কি কলকাতা থাকলে ভাতের অভাব হতো।?

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, গ্রামগুলো মরে গেছে, তিনি গ্রামগুলোকে বাচাতে চেষ্টা করছেন। তিনি মানবতার জয়গান গেয়েছেন, তিনি সবসময় মানুষকে ভরসার কথা শুনিয়েছেন। চাষীদের দুঃখ যাতনা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন।

জামাতা নগেন্দ্রনাথকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'চাষীদের সঙ্গে আলাপ করে এক সাথে চাষ করা, ব্যাংক করা, ওদের স্বাস্থ্যকর বাসস্থান স্থাপন করা, ঋণ মোচন করা, ছেলেদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বৃদ্ধ বয়সের সংস্থান করে দেয়া, রাস্তা করা, বাঁধ বেঁধে দেয়া, জলকষ্ট দূর করা পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য সূত্রে আবদ্ধ করা।

মুসলিম লেখকদের তিনি যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন, যেভাবে তাঁদের সমাদর করেছেন, যেভাবে তাঁদের তুলে ধরেছেন, তাঁদের বিখ্যাত হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছেন। তা আর কেউ করেছেন কিনা জানি না। সেই সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সময়ে আরও যারা বিখ্যাত অমুসলিম লেখক ছিলেন তাঁরা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন। হাছন রাজার গান রবীন্দ্রনাথের হাতে যখন পড়লো তখন তিনি এতটাই মুগ্ধ হলেন যে তিনি ভারতীয় দর্শন মহাসমাবেশের অধিবেশনে যে ভাষণ দিলেন তাতে হাছন রাজার গানের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি লালনের গান সংগ্রহ করেছেন। লালনের গান তিনি প্রকাশ করেছেন। একে একে লালনের গান তিনি প্রকাশ করেছিলেন। লালনের গানের দুটি খাতা তিনি ছেউড়িয়া থেকে সংগ্রহ করেছিলেন এবং সেটি এখন বিশ্ব ভারতীর রবীন্দ্রভবনে সংগৃহিত আছে।

তিনি অসি নয়, জ্ঞানের আলো জ্বেলে পৃথিবীকে এক শান্তির অভয়ারণ্য গড়তে তাঁর সারাটা জীবন উৎসর্গ করেছেন। চাইবো না যে রবীন্দ্র সত্বাটিকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে যা দেখে সবাই নিজেই বিব্রত হোন। রবীন্দ্রনাথ কখনো কখনো এর শিকার হয়েওছিলেন । রবীন্দ্রনাথও একজন মানুষ তবে প্রত্যাশাতো রবীন্দ্রনাথের কাছে একটু বেশিই থাকবে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ যা, তা আমাদের বলা উচিৎ।

তিনি মানুষের ভেতরের শক্তি ও সৌন্দর্যের উন্মোচন করে মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং কর্মপ্রেরণাকে কার্যকরী শক্তিতে রূপদান করার আন্তরিক প্রয়াস চালিয়ে গেছেন এবং স্বার্থক বাঙালী মানস গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্যতম উৎসাহদাতা তিনি। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ এক শাণিত হাতিয়ার। তিনি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে শক্তি ও সাহস জুুগিয়েছেন। ষাটের দশকে পাকিস্থানি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমাদের উল্লেখযোগ্য শক্তি-উৎস। মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের চিত্তে সঞ্চার করেছে অফুরন্ত সাহস। 

রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি জীবনে অনেক স্ববিরোধীতা ছিল। সেগুলো আমি কখনই অস্বীকার বা বড় করে দেখবো না। ভাল-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। আমরা রবীন্দ্রনাথকে মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অনেক কথা হয়েচে ষড়যন্ত্র হয়েছে, কিন্তু তাতে তার জনপ্রিয়তার কোন সমস্যা হয়নি। আজ তার জন্মের ১৫৮ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও তার বই সব থেকে বেশি বিক্রি হয়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, একজন শিল্পীকে তার শিল্প দিয়েই বিচার করা হোক। যেখানে কবি সাহিত্যিকদের বেশিরভাগেরই প্রতিষ্ঠা আসে জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরের মধ্যে, তারপর তাদের মোটামুটি বন্ধ্যাত্ব নেমে আসে। সেখানে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্য লিখে গিয়েছেন। উৎকর্ষের দিক দিয়ে শেষের লেখাগুলো ছাড়িয়ে গিয়েছে প্রথম রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের মানুষ হিসেবে যে সীমাবদ্ধতা আছে তা স্বীকার করে তার ভুলগুলো গ্রহণ করেও আমি তাকে স্বীকার করি।

বর্তমানে আমার পাড়ায় সকাল যখন হয় চেচামেচি কিংবা চিল্লাচিল্লিতে, ঘুম ভাঙ্গে বকাবকির শব্দে, তখন আমার মন কেমন যেন আনচান করে। আমি কোন শব্দ খুঁজতাম। কোন আশ্রয় খুজঁতাম। চাইতাম অন্য কোন দূশ্য। এমনি একদিন পেয়ে গেলাম লাইব্রেরীর ঠিকানা।ক্লাসের বাইরে কত আলো, কত আনন্দ সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের সাথে এই লাইব্রেরীতেই পরিচয়। সেই প্রথম আমার রবীন্দ্রনাথ আমার অন্য জীবন।

একটা সময় আমাদের এই ছোট শহরে দারুন সাংস্কৃতিক বলয় ছিল। তখন পাড়ায় পাড়ায় ক্লাব ছিল।বিভিন্ন সময় গান হত নাটক হত। বিভিন্ন পুজাঁ পার্বনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল সৌহাদ্যপূর্ন। হিন্দু মুসলমান পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ছিল। একে অন্যের বিপদে সাহায্য করতো।প্রতিযোগিতা নয় সহযোগিতার দিন ছিলো।

সেটা নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সাধনার ফল। তখন আমরা পাড়ার সকল ছেলে মেয়ে মোরা ভাই ভাই একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই। তারপর আমরা আস্তে আস্তে বিষ বাস্পের তীব্রতা পেতে শুরু করি। আমরা হিন্দু আর মুসলমানের পার্থক্য বুঝতে শিখি। বুঝতে শিখি নারী পুরুষের সম্পর্ক। আমাদের বোঝানো হয় বিভিন্ন কুমন্ত্রের ছড়া, অন্য পড়া অন্য পাঠশালা।আমাদের শেখানো হয় শিক্ষা গ্রহন করে কেমন করে মানুষকে ঠকাতে হয়। ফাইল আটকে রেখে কেমন করে অর্থ আদায় করতে হয়। আর চতুরতা করে মানুষকে ঠকাইতে হয়। দ্বিজাতিতত্ব বের করে কেমন করে মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়ানো যায়।

আমরা বড় হয়েছি এই কথাশুনে যে, রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অনেক লেখা চুরি করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের কবি। আজব ব্যাপার হচ্ছে যে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি যখন এইসব মেনে নেয় তখন এসব ধারনা আমাদের মনে বিশ্বাসে পরিনত হতে থাকে। গড়ে ওঠে এক অন্য সাংস্কৃতিক বলয় আর হাসতে থাকে দানবেরা। আমরা পরাজিত হই। পরাজিত হই ঠিকই কিন্তু ধ্বংশ তো নয়।

রবীন্দ্রনাথ এসে আবার আমাদের হাত ধরেন। আমাদের চোখের জল মুছে উঠে দাড়াতে বলেন। আমাদের শেখান যুদ্ধ জয়ের মন্ত্র, আমাদের শেখান ভালবাসা। মানুষে মানুষে মতৈক্য দুর করার অমোঘ মন্ত্র। হিংস্র দানবেরা ফুঁসতে থাকে।

(রবীন্দ্রনাথ- যাঁকে বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠে নি। এমনই প্রতিভা ঐ কবির, তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান, তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন; তাঁর একটি সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেন।

প্রতিক্রিয়াশীল নষ্টরা অনেক লড়াই করেছে তাঁর সাথে, পেরে ওঠেনি; তাঁকে মাটি থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আকাশ হয়ে ওঠেন; জীবন থেকে তাঁকে নির্বাসিত করা হলে তিনি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন জাতির স্বপ্নালোকে।

নষ্টরা তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে আপ্রাণ। যদিও তিনি জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা, তবুও তিনি জাতীয় কবি নন। তাঁর নামে ঢাকায় একটি রাস্তাও নেই; সংস্থা তো নেই। তাতে কিছু যায় আসে নি তাঁর; দশকে দশকে বহু একনায়ক মিশে যাবে মাটিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙলায় ও বিশ্বে।”

ড. হুমায়ুন আজাদ--- জলপাই রঙের অন্ধকার)

আমার বিশ্বাস তোমার হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথ এই শহরে আবার আসবেন। অসুর ধ্বংশ করে নতুন সুর রচনা করবেন। নতুন সাংস্কৃতি তৈরি হবে তোমার নিয়ে। তোমার হাত ধরে তখন সাংস্কৃতি ছাড়া কোন রাজনীতি থাকবেনা। অর্থনীতি থাকবে সাংস্কৃতিক বলয়ে। পাখিরা গান গাইবে নির্ভয়ে। বাগানে ফুল ফুটবে। শিশুরা আবার হাসবে।

তিনিই তো বলেছিলেন "সংকটের কল্পনাতে হইওনা ম্রিয়মান.....মুক্ত করো ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো
নিজেরে করো জয়।

রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে এই প্রত্যাশা থাকলো।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.