May 14, 2025, 10:55 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2025-05-14 18:26:46 BdST

দুর্নীতির নেপথ্য কারিগর এপিডি রহিম ও তার সিন্ডিকেটকারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের এসেট প্রকল্প দুর্নীতি চারনভূমি


কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন Accelerating Skills for Economic Transformation (ASSET) প্রকল্প বাংলাদেশের দারিদ্রতা এবং বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য অন্যতম একটি ফ্লাগশিপ প্রকল্প।

এই প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের বেকার যুবক, নারী ও অবহেলিত নৃগোষ্ঠী জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করা। এসেট প্রকল্প ৫ বছর মেয়াদী যা বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।

এসেট প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪৩০০ কোটি টাকা) যার মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং বিশ্বে ব্যাংক লোন ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

জনশ্রুতি আছে যে, এই প্রকল্পটিতে নানাবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা এবং প্রকল্পে কর্মরত কর্মকর্তা ও পরামর্শকদের থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে।

এসেট প্রকল্পের সাবেক অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক যিনি বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাপন্থী কর্মকর্তা যুগ্মসচিব মো: আব্দুর রহিম উক্ত প্রকল্পে চরম আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন মর্মে অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তার অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে তাকে প্রকল্প থেকে প্রত্যাহার করে অতি সম্প্রতি অন্যত্র বদলি করেছে।

ঘুষ, নিয়োগ বাণিজ্য ও আত্মীকরণে ডুবছে অ্যাসেট প্রকল্প

এসেট প্রকল্পের আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে এসেট প্রকল্পে। এই প্রকল্পে দায়িত্বরত অনেক কর্মচারী ও পরামর্শক সাবেক অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক ও যুগ্মসচিব মো: আব্দুর রহিমের নিকট আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজন; যাদের সকলের বাড়ী পাবনায়। অনেকেই এসেট প্রকল্পকে পাবনা প্রকল্প বলে অভিহিত করেন।

এসেট প্রকল্পের অফিস সহায়ক হাসিবুল হাসান তার আপন ভাগ্নে (বোনের ছেলে)। এছাড়া নয়ন আলি (ভাগিনা জামাই), মো: সরওয়ার বিশ্বাষ আপন মামা শ্বশুর (স্ত্রীর আপন মামা), গাড়ী চালক মো: আল আমিন খাঁন সবাই তার আত্মীয়-স্বজন। এছাড়া লোক দেখানো নিয়োগ পরীক্ষায় যোগ্যদের বাদ দিয়ে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহিম ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের লোক নেয়ায় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অনেক কমকর্তা অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে এই প্রকল্পে নিযুক্ত জনৈক গাড়ী চালক জানান যে, তার যোগদানের পরে প্রথম কয়েক মাসের বেতন এপিডি আব্দুর রহিমকে দিয়ে দিতেন এবং তার ওভারটাইমের টাকা দিয়ে জনাব আব্দুর রহিম তার ব্যক্তিগত গাড়ী চালকের বেতন দিতেন। এছাড়া তিনি প্রকল্পের ক্রয় ও নিয়োগ কমিটির আহবায়ক হওয়ায় ক্রয় ও পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম করেন এবং অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ প্রদান করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পরামর্শক এই প্রতিবেদকের কাছে অর্থ প্রদানের কথা স্বীকার করেছেন।

প্রকল্প পরিচালক মীর জাহিদ হাসান ও অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো: আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে কমিউনিকেশন স্পেশালিষ্ট পদে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিউনিকেশন স্পেশালিষ্ট পদে আবেদনকারী একজন অভিযোগ করেন যে, তাদেরকে কোন মৌখিক সাক্ষাৎকারে আহবান করা হয়নি। কমিউনিকেশন স্পেশালিষ্ট পদে STEP প্রকল্পে কর্মরত জিল্লুর রহমানকে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পুনরায় নিয়োগ করা হয়। কমিউনিকেশন স্পেশালিষ্ট জিল্লুর রহমান ASSET প্রকল্পের ডিপিপি (প্রকল্পের মূল দলিল) প্রস্তুতির সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। কারিগরি অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। বিধি অনুযায়ী কেউ প্রকল্পের ডিপিপি (প্রকল্পের মূল দলিল) প্রস্তুতের সাথে অথবা প্রকল্পের অপারেশন ম্যানুয়াল প্রস্তুতের সাথে সরাসরি জড়িত থাকলে তাকে conflict of interest এর কারনে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে নিয়োগ প্রদান করা যায় না। ইতোপূর্বে স্কিলস ট্রেনিং স্পেশালিষ্ট পদে নিয়োগে প্রকল্পের অপারেশন ম্যানুয়াল প্রস্তুতের সাথে জড়িত থাকায় conflict of interest এর কারনে একজন স্পেশালিষ্টের নিয়োগে বিশ্বব্যাংক হতে আপত্তি দেয়ায় নিয়োগ বাতিল করা হয়।

কিন্তু বর্তমানে বহুল আলোচিত STEP প্রকল্পের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা ও স্পেশালিষ্টগন পুনরায় ASSET প্রকল্পে সিন্ডিকেট গড়ে তোলায় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। তারা এই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের অনুরাধ করেছেন।

কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি

অনুসন্ধানে জানা যায় যে, এসেট প্রকল্পের ক্রয় কমিটির আহবায়ক জনাব মো: আব্দুর রহিম প্রকল্পের ফার্নিচার, টিভিসি ও অন্যান্য কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্পের ক্রয় কমিটির একজন সদস্য বলেন, প্রকল্পের ব্যবহারের জন্য প্রায় ৭৩ লক্ষ টাকার আসবাবপত্র হাতিল ফার্নিচার হতে ক্রয় করা হয়। ফার্নিচার ডেলিভারির পরে প্রকল্প দপ্তরে রাখার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের করিডোরে দামি ফার্নিচারগুলো অনেকদিন ফেলে রাখায় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফার্নিচার কেনায় ও বাইরে ফেলে নষ্ট করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

কমিটির সভাপতি মো আব্দুর রহিম প্রকল্পর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হাতিল হতে ক্রয় করার সুপারিশ করেন। প্রকল্পের প্রাক্তন এক কর্মকর্তা বলেন যে ফার্নিচার ডেলিভারির পরে বিল প্রদানের সময়ে হাতিলের সেলস ম্যানেজার হালিমা কাকনকে তিনি দেখা করতে অনুরোধ করেন। কাকনের কথাবার্তা সন্দেহজনক হওয়ায় তিনি বিষয়টি প্রকল্প পরিচালককে অবহিত করেন। সাবেক প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহিমকে ডেকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে তিনি বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রকল্প পরিচালক কাকনকে কয়েকবার তার সাথে দেখা করার জন্য অনুরোধ করলেও তিনি প্রকল্প অফিসে আসতে অস্বীকৃতি জানান। পরবর্তীতে প্রকল্প পরিচালক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলায় তিনি দেখা করেন এবং জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে স্বীকার করেন যে কাজটি পাইয়ে দেয়ায় তিনি ক্রয় কমিটির সভাপতি আব্দুর রহিমকে অগ্রিম নগদ পাঁচ লক্ষ টাকা ঘুষ (গিফট হিসেবে) প্রদান করেন।

তিনি আরো জানান যে তিনি অনেক আগে থেকেই কমিটির সভাপতি আব্দুর রহিমের পূর্বপরিচিত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির অন্য একজন সদস্য বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

সূত্র মতে, কমিটির আহবায়ক নিজেই পছন্দ মতো স্পেসিফিকেশন ম্যানুপুলেট করে তার পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে অর্থের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেন। এছাড়া ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান বর্ণমালা-কে তিনি কমিশনের বিনিময়ে স্কিলস প্রতিযোগিতাসহ একাধিক কাজ পাইয়ে দিতেন।

ইউরো বাংলা মিডিয়া নেটওয়ার্ক হতে প্রকল্পের টিভিসি নির্মান ও ক্রয়ে মো: আব্দুর রহিমের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ক্রয় ও নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জনাব মো: আব্দুর রহিমের সিন্ডিকেটের সহযোগী প্রোগ্রাম অফিসার জনাব মাজহারুল আমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বললে তিনি কোন উত্তর দেননি।

নির্মাণ ও গণপূর্ত কাজে হয়েছে হরিলুট

অনুসন্ধানে জানা যায় যে, এসেট প্রকল্পের দপ্তর মেরামতে, নির্মান ও পূর্ত কাজেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে সম্পাদিত এসেট প্রকল্পের বিভিন্ন কক্ষ, টয়লেট, কনফারেন্স রুম চাহিদা মোতাবেক সমাপ্ত করা হয়নি। নির্মান ও পূর্ত কাজে মোট ১ কোটি ২৩ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছে। কাজের প্রথমেই কয়েকটি বাথরুমে ব্যবহার করা পুরোনো ফিটিংস ও টাইলস ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে বিষয়টি প্রকল্প কর্মকর্তাদের নজরে পড়লে গণপূর্ত অধিদপ্তরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অভিযোগ দিলে তিনি বলেন যে, প্রকল্পের ডিপিডি রাকিবুল হাসানের নির্দেশে তারা পুরোনো ফিটিংস ও টাইলস ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে সাবেক প্রকল্প পরিচালক রাকিবুল হাসানকে এজন্য তিরষ্কার করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় যে, প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের কক্ষ, অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালকের কক্ষ এবং কনফারেন্স রুম ব্যতীত অন্যান্য কক্ষে শুধুমাত্র রং করা ও পর্দা পরিবর্তনের মধ্যেই মেরামত ও পূর্ত কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। এখনও সকল কক্ষে STEP প্রকল্পের ব্যবহত লাইট, ফ্যান ও এসি ব্যবহার হরা হচ্ছে। অথচ প্রকল্প দলিলে সকল রুমের জন্য সম্পূর্ন রিনোভেশনসহ এসি, ফ্যান ও লাইট এর অর্থ বরাদ্দ ছিল।

প্রকল্পের একজন সিনিয়র পরামর্শক নির্মান ও পূর্ত কাজের মান নিয়ে প্রকল্প পরিচালকের কাছে অভিযোগ করায় কমিটির আহবায়ক মো: আব্দুর রহিম ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিপিডি রাকিবুল হাসান উক্ত পরামর্শকের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। এই বিষয়ে রাকিবুল হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদের কথা বললে তিনি কোন উত্তর দেননি। বর্তমানে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট অডিট অধিদপ্তরে এসেট প্রকল্পের নির্মান ও পূর্ত কাজের ব্যাপক অনিয়মের বিষয়ে আপত্তি রয়েছে যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।

অনৈতিক সম্মানী গ্রহন

এসেট প্রকল্পের আওতায় শর্ট কোর্স, আইডিজি, আরপিএল ও এন্টারপ্রাইজভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সময় মোঃ আব্দুর রহিম ও রাকিবুল হাসানের নামে বিভিন্ন আইএসসি, বিজনেস চেম্বার ও বিজনেস এসোসিয়েশেন হতে কাজ পাইয়ে দেয়ার জনা অনৈতিকভাবে সম্মানী (ঘুষ) আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন এসোসিশেন ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের প্রধানগন সম্মানী (ঘুষ) প্রদানের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। বিভিন্ন আইএসসি ও বিজনেস এসোসিশেনের কর্মকর্তারা মনে করেন যে, এসকল বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

এপিডি আব্দুর রহিমের দুর্নীতির টাকা শাশুড়ির একাউন্টে

অনুসন্ধানে জানা যায় যে, জনাব মো: আব্দুর রহিম তার শাশুড়ি লুতফুন নাহার হেনার ব্রাক ব্যাংকের একাউন্টে মাধ্যমে ঘুষের টাকা গ্রহণ করতেন।

এছাড়া তিনি তার কয়েকজন নিকট আত্মীয়ের মাধ্যমেও প্রায় ৪-৫ কোটি টাকা ঘুষের অবৈধ অর্থের লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাগন ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের মালিকবৃন্দ তার বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছেন।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.