শাহীন আবদুল বারী
Published:2025-08-13 13:14:31 BdST
পুলিশও ছিনতাইকারীর শিকার
রাজধানীর কারওয়ান বাজার সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে ছিনতাইকারীর হামলার শিকার হয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। সোনারগাঁও ক্রসিংয়ে মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে এই ঘটনা ঘটে।
হামলার শিকার ওই পুলিশ কর্মকর্তা ডিএমপির প্রটেকশন বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (বঙ্গভবন নিরাপত্তা) মো. সুমন রেজা। ছিনতাইকারীকে ধরতে গেলে তখন হাতে থাকা ছুরি দিয়ে এডিসি সুমন রেজাকে আঘাত করেন ছিনতাইকারী। এতে এডিসি সুমন রেজার ডান হাতের মধ্যমাংশে কেটে যায় এবং ছিনতাইকারী পালিয়ে যায়।
ছিনতাইকারীরা ইদানীং এতটাই বেপরোয়া যে, একজন পুলিশ অফিসারও তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। বর্তমান সময়ে সন্ধ্যার পর পথচারীরা নিরাপদে চলতে পারছেনা। প্রতিনিয়তই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা।
গত ৩০ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে পুরাতন জেলখানাসংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল মোরশেদ আলম তানিম (১৮)। সেখানে দুই ছিনতাইকারী পেছন থেকে এসে তাকে ধরে ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তানিম চিৎকার দিলে তার পেটে চাকু মারে ছিনতাইকারীরা। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২ জুলাই ভোরে মারা যান তিনি।
এছাড়া ১৭ জুলাই রাত সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নিউ মডেল বহুমুখী হাইস্কুলের বিপরীত পাশে চাপাতি দেখিয়ে ছিনতাই করার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, চাপাতি দিয়ে ভয় দেখিয়ে এক যুবকের কাছ থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক ব্যক্তি। পরে মূল সড়কে এসে ট্রাফিক পুলিশের পাশ নিয়েই চলে যাচ্ছে এই ছিনতাইকারী।
শুধু পুরান ঢাকা বা ধানমন্ডি নয়, মিরপুর, মগবাজার, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, উত্তরা, গুলশানসহ নগরীর প্রায় সব স্থানেই প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় ছিনতাইয়ের ঘটনা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নগরবাসীর কাছে এখন ছিনতাই এক আতঙ্কের নাম। সন্ধ্যা নামলেই তৎপরতা বাড়ে ছিনতাইকারীদের। সড়কের ফুটপাতে চলার পথে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে নেওয়া হচ্ছে সর্বস্ব। যানবাহন থামিয়েও ছিনতাই করা হচ্ছে। ছিনতাইকারীদের চাকু না খুরের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে প্রাণও দিচ্ছেন অনেকে।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে, রাজধানীর এসব ছিনতাইকারীর বেশির ভাগই পুলিশের তালিকাভুক্ত। এমনকি কে কোন এলাকায় থাকে, তার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। শুধু তাই নয়, এই মুহূর্তে ৯৭২ জন ছিনতাইকারী যে সক্রিয় সেই তথ্য আছে পুলিশের কাছে । এরপরও কেন ছিনতাইকারীদের অবাধ বিচরণ-এমন প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট সবার।
পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিটের তৈরি তালিকা থেকে পাওয়া গেছে ছিনতাইকারীদের উল্লিখিত তথ্য। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। এমনই এক ছিনতাইকারী সুমন বাবুর্চি। তার বাবার নাম আলী বাবুটি। রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন জহুরাবাদে বাসা। এক যুগের বেশি সময় ধরে নিয়মিত ছিনতাই করে সুমন বাবুর্তি। দিয়াবাড়ি বেড়িবাঁধ এলাকা ছাড়াও ধানমণ্ডি এলাকায় তার অবাধ বিচরণ। ছিনতাইয়ের ঘটনায় দারুসসালাম থানা পুলিশের কাছে প্রথম গ্রেফতার হন ২০১৪ সালের ২২ জুন (মামলা নম্বর-২৮)। পরে ধানমন্ডি ও দারুসসালাম খানা এলাকায় ২০১৫, ২০১৭, ২০২০, ২০২১ ও ২০২৩ খালে ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় সুমন বাবুর্চি। প্রতিবারই
একাধিকবার গ্রেফতারের পর জামিনে মুক্ত হয়ে ফের জড়াচ্ছে ছিনতাইয়ে-পুলিশ
পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ মামলার কারণে অনেক ছিনতাইকারী জামিন পেয়ে যায়। জামিনে মুক্ত হয়ে ফের জড়িয়েছে ছিনতাইয়ে।
ডিএমপির দারুসসালাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রকিব-উল-হোসেন বলেন, 'সুমন বাবুর্চিকে গ্রেফতার করে একাধিকবার চালান দিয়েছি।' তিনি আরও বলেন, 'ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনায় কেউ জড়িত থাকলে বা সন্দেহভাজন হলে তাকে গ্রেফতার করে চালান দিয়ে থাকি। এরপর সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকলে চার্জশিটও দেই। এদের অনেকে জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের ছিনতাই শুরু করে।'
ছিনতাইকারীর তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, মতিঝিলের তাস মো. বাবুল। কমলাপুর রেলস্টেশন, খিলগাঁও রেলগেট ও মালিবাগ এলাকার ছিনতাইয়ের নিয়ন্ত্রক সে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ছিনতাই করে চলেছে বাবুল। তার বিরুদ্ধে ডিএমপির শাহজাহানপুর থানায় ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনটি ডিনায়াইয়ের সামলা রয়েছে। একই এলাকার চিহ্নিত ছিতাকারী মো. শাহাদত ও ভাতে মরা রবিন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তিনটি করে ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। একই এলাকার ছিনতাইকারী শাওন গাজী ও বিয়ান ওরফে ওস্তাদ বিল্লালের বিরুদ্ধে দুটি করে ছিনতাই মামলা রয়েছে। মতিঝিলের আলমের নেতৃত্বে ছিনতাইকারীরা সক্রিয়। আলম আওয়ামী লীগ সরকার আমলে যুবলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল।
জানতে চাইলে শাহজাহানপুর থানার ওসি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'আমরা এসব ছিনতাইকারীদের অনেককেই তিন থেকে চারবার গ্রেফতার করে চালান করেছি। কিন্তু তারা জামিনে বের হয়ে ফের ছিনতাইয়ে যুক্ত হয়। আমাদের কাজ এদের (ছিনতাইকারীদের) ধরা আর জমিন দেয়ার মালিক কোর্ট।'
মিরপুর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ সাজ্জাদ রোমন বলেন, এই এলাকায় ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করা হয়েছে। শেওড়া পাড়া ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশের বিশেষায়িত ওই ইউনিটের তালিকায় দেখা গেছে, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারীর অবস্থান তেজগাঁও ও মিরপুর বিভাগে। এ দুটি বিভাগে ৩৮০ ছিনতাইকারীর নাম উঠে এসেছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এর মধ্যে ২২৩ ছিনতাইকারীর অবস্থান তেজগাঁও বিভাগে। এছাড়া রমনা ও লালবাগ বিভাবে ২২০, ওয়ারী ও মতিঝিল বিভাগে ২০৫, গুলশান ও উত্তরা বিভাগে ১৬৭ জন ছিনতাইকারী দাপিয়ে বেড়ায়।
জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, 'আমরা নিয়মিত ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করছি। পরে অনেকে জামিনে বের হয়ে একই অপরাধ করছে।'
ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মুহাম্মদ সামছুদ্দোহা সুমন বলেন, পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ মামলার কারণে অনেক ছিনিতাইকারী জামিন পেয়ে যায়। যদিও সিএমএম কোর্ট এখন জামিন দিচ্ছেন না। এ ব্যাপারে আমরা রাষ্ট্র পক্ষ থেকে সব সময় সচেতন আছি।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.