December 19, 2025, 10:24 am


সামিউর রহমান লিপু

Published:
2025-12-19 02:20:15 BdST

না ফেরার দেশে ওসমান হাদি


চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র এবং ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদি।

টানা ৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশ সময় বৃহষ্পতিবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মো. আব্দুল আহাদ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাতে গণমাধ্যমকে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন।

এসময় তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টার দিকে ওসমান হাদির পরিবার চিকিৎসকদের শেষ চেষ্টা হিসেবে একটি অস্ত্রোপচারের জন্য সম্মতি দেন। পরে তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। ৪ ঘন্টাব্যাপী দীর্ঘ এই অস্ত্রোপচার শেষ হওয়ার পর ওসমান হাদির শরীরে প্রানের কোন অস্তিত্ব না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে।'

তিনি আরও বলেন, 'হাদির মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পর সেখানে আবেগঘন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এসময় হাসপাতালের চিকিৎসকরা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে আমরা মর্মাহত। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দিয়েও আমরা ওসমান হাদিকে বাঁচাতে ব্যর্থ হলাম।'

শুক্রবার সন্ধ্যায় দেশে আসবে মরদেহ

সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ওসমান হাদির পরিবারের আলোচনা শেষে মরদেহ শুক্রবার সন্ধ্যায় সিঙ্গাপুর থেকে দেশে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

এনসিপির স্বাস্থ্য সেলের প্রধান ও হাদির চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকা ডা. আব্দুল আহাদ সাংবাদিকদের এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘ওসমান হাদির মরদেহ শুক্রবার বাংলাদেশ বিমানের একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে ৩টা ৫০মিনিটে সিঙ্গাপুর থেকে রওয়ানা হয়ে সম্ভাব্য সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫মিনিটে ঢাকায় অবতরণ করবে। ’

দুই দফা জানাজা

শরিফ ওসমান হাদির মরদেহ দেশে ফেরানোর লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমে সিঙ্গাপুর এবং পরে বাংলাদেশে পৌঁছানোর পর ঢাকায় জানাজা ও দাফনের কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়েছে।

শরিফ ওসমান হাদির প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হবে শুক্রবার সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুরের অ্যাঙ্গুইলা মসজিদে।

অন্যদিকে, মরদেহ দেশে পৌঁছানোর পর প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে শনিবার বাদ জোহর ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা হবে।

পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জানাজা শেষে গ্রামের বাড়ি নলছিটিতে নিয়ে যাওয়া হবে ওসমান হাদির মরদেহ। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।

নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবারকে কথা না বলার নির্দেশ

রাতে নিরাপত্তার স্বার্থে ওসমান হাদির পরিবারের কোনো সদস্য কারও সঙ্গে কথা বলবেন না—এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পারিবারিক নিরাপত্তা ও অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নলছিটি থানা পুলিশ।

নলছিটি থানার এসআই শেরজাহান জানান, 'ওসমান হাদির মৃত্যুর পর তাত পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এই কারণে রাতে কারো সাথে তারা কথা বলবেন না বা দেখা করবেন না। শুক্রবার সকালে তারা সবার সাথে কথা বলবেন।'

ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। দলমত নির্বিশেষে সবাই হাদির এই মর্মান্তিক মৃত্যুতে মর্মাহত। 

শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা

ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ওসমান হাদির অকাল মৃত্যুতে আগামী শনিবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করছি। এই উপলক্ষে শনিবার দেশের সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারি ভবন, বিদেশে থাকা বাংলাদেশের মিশন সহ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে।

একই সাথে শুক্রবার বাদ জুমা দেশের প্রতিটি মসজিদে শহীদ ওসমান হাদির রূহের মাগফেরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাতের আয়োজন করা হবে। অন‍্যান‍্য ধর্মের উপাসনালয়গুলোতেও আয়োজন হবে বিশেষ প্রার্থনার।

এর আগে, গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে জুমার নামাজ পড়ে ফেরার পথে রাজধানীর পল্টনের বিজয়নগর এলাকায় মোটরসাইকেলে এসে দুই যুবক শরিফ ওসমান হাদিকে মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়।

গুরুতর আহতাবস্থায় দ্রুত ওসমান হাদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে প্রাথমিক সার্জারি (অস্ত্রোপচার) করেন চিকিৎসকরা। অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

সেখানে সিসিইউতে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে ওসমান হাদিকে গত সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। দীর্ঘ সময় জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা হাদী আজ রাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। 

ব্যক্তিগত জীবন

শরিফ ওসমান হাদি ১৯৯৩ সালে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ছিলেন। পিতার আদর্শ ও নৈতিক শিক্ষা হাদির জীবন গঠনে গভীর প্রভাব ফেলেছিলো। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম।

ওসমান হাদির শিক্ষা জীবনের ভিত্তি গড়ে ওঠে ঝালকাঠির বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসায়। সেখান থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। পরে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন হাদি। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স এবং মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।

ছাত্রজীবন শেষ করার পর হাদি জ্ঞান বিতরণের মহান পেশা শিক্ষকতাকে বেছে নেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি একটি স্বনামধন্য কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। এখানে থাকা অবস্থায় তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এরপর তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

শরিফ ওসমান হাদি এক সন্তানের জনক। পরিবার, শিক্ষকতা ও জ্ঞানচর্চাকে ঘিরেই তার প্রাত্যহিক জীবন আবর্তিত হতো।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.