August 15, 2025, 11:30 pm


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-08-02 10:02:59 BdST

৩০০ প্রকৌশলীর আয়কর ফাঁকির তদন্ত শুরু


সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কর ফাঁকির বিরুদ্ধে নেওয়া দৃঢ় এক উদ্যোগের অংশ হিসেবে, সরকারের ৩০০ প্রকৌশলীর আয়কর ফাঁকির তদন্ত শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরের আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট।

এর মধ্যে এলজিইডির ৩০ জন এবং সড়ক ও জনপথের ১০ জন। বাকিরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত, পিডিবি, ওয়াসা, বিভিন্ন সিটি করপোরেশনসহ সরকারি অন্যান্য দপ্তরে কর্মরত রয়েছেন।

বিষয়টি নিশ্চিত করে কর বিভাগের গোয়েন্দা শাখা আইটিআইআইইউ- এর কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রাকিব বলেন, "প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রায় সবার ফাইলেই কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয় জন তাদের কর ফাঁকি স্বীকার করে ইতোমধ্যে ট্যাক্স পরিশোধ করেছেন, যার পরিমাণ একেক জনের কমপক্ষে এক কোটি টাকা।"

সূত্র মতে, এই তালিকায় থাকা কর্মকর্তাদের পদ-পদবী বেশ ক্ষমতাধর, প্রায় ১০০ জন রয়েছেন যারা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত।

তাদের সঙ্গে রয়েছেন ২৫ জন বিচারক, ১০ জন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট কর্মকর্তা এবং ওয়াসা, রেজিস্ট্রেশন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারা।

অভিযুক্ত বেশিরভাগ প্রকৌশলী ২ থেকে ৩ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের আয়কর নথি বিভিন্ন কর অঞ্চল থেকে আয়কর গোয়েন্দার কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই তদন্ত শুরু হয় বলে জানিয়েছে আয়কর গোয়েন্দা বিভাগের অভ্যন্তরীণ সূত্র। এরপরই শুরু হয় সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদের কর ফাইলের বিস্তৃত অনুসন্ধান, যেখানে কর ফাইলে অঘোষিত আয়, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ ঘোষণা এবং অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এরমধ্যে দুটি ঘটনার উদাহরণ দেওয়া যায়, যারমধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা এবং এলজিইডির একজন নির্বাহী প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রায় ১০ কোটি টাকার অঘোষিত সম্পদের অধিকারী তারা। এদের মধ্যে একজন ইতোমধ্যেই ১ কোটি টাকা করফাঁকি স্বীকার করে তা পরিশোধ করেছেন।

আয়কর গোয়েন্দার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রায় সবার ফাইলেই কর ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ছয় কর্মকর্তা তাদের করফাঁকি স্বীকার করে ইতিমধ্যে কর পরিশোধ করেছেন, বাকিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে।

কর কর্মকর্তারা বলছেন, এই তদন্তে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ের নয়, বরং আরও গভীর ও কাঠামোগত ক্ষমতার অপব্যবহার, ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য অনৈতিকতায় জড়ানো উদঘাটিত হতে পারে।

ফলে এই তদন্ত নিছক করদাতার হিসাব খতিয়ে দেখার বিষয় না। গত ছয় মাসে আইটিআইআইইউ প্রায় ৩০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কর ফাইল পর্যালোচনা করে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকার কর ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে। এর মধ্যে ১১৮ কোটি টাকা ইতোমধ্যে আদায় করা হয়েছে, যা ক্ষমতাবানদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার দৃঢ় পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আয়কর গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তরা দেশে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের নামে স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ গড়ে তুলেছেন। মৎস্য ও পোলট্রি খামারে বিনিয়োগের নামে অবৈধ আয় গোপন করে কর ফাঁকি দিয়েছেন।

এই বিষয়ে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রাকিব বলেন, ‘কয়েকজন প্রকৌশলীর সব ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। কর ফাঁকি শনাক্ত হওয়ায় কর বাবদ কয়েকজন প্রকৌশলী তাদের কর জমাও দিয়েছেন। এসব প্রকৌশলীর আয়কর নথিতে প্রদর্শন না করা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ খোঁজা হচ্ছে। তাদের বিষয়ে রেকর্ডপত্র চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রিহ্যাব, ভূমি অফিস, বিআরটিএ, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

এসব প্রকৌশলীর মধ্যে সিলেট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসেন, তার স্ত্রী মাহফুজা খাতুন ও মেয়ে তাসমিয়া ফাতেহা ফারুকের সব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা হয়েছে। গত ২৭ এপ্রিল বিভিন্ন ব্যাংকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয়। তাদের তিনজনের ৩ কোটি টাকার বেশি কর ফাঁকির তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের নামে ৮০টির বেশি এফডিআর রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগ আয়কর নথিতে প্রদর্শন করা হয়নি। মেয়ের নামে মৎস্য ও পোলট্রি খামার থেকে আয় প্রদর্শন করা হলেও খামারের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তিনি খুলনা কর অঞ্চলের সাতক্ষীরা সার্কেলের করদাতা।

এলজিইডির আরেক প্রকৌশলী এস এম কবির ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ২ কোটি টাকার কর ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে আয়কর গোয়েন্দা।

প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমানের বাড়ি লক্ষ্মীপুর। তিনি সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী। তার স্ত্রীর নামে আটতলা বাড়ি পাওয়া গেছে। কর ফাঁকি শনাক্ত হওয়ায় এই প্রকৌশলী এরই মধ্যে ১ কোটি টাকার কর জমা দিয়েছেন।

এছাড়া এলজিইডির ফিরোজ আলম তালুকদার, বাচ্চু মিয়া, সড়ক ও জনপথের মনিরুল ইসলাম, পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ ও পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান, সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দিন খান ও সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলে রব্বেসহ ৩০০ প্রকৌশলীর আয়কর নথির তদন্ত চলছে।

তাদের মধ্যে খালেদ মাহমুদ ২০১৬ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ৩৪তম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান। এর আগে তিনি পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর এক বছর মেয়াদে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে তিনি ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পিডিবির ৩৮তম চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অতীতে তিনি পিডিবির সদস্য, কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সবুজ উদ্দিন খান। সরকার বদলের পর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ঢাকা সার্কেলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদ থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে জয়দেবপুর-বেদগ্রাম-ভূলতা-মদনপুর বাইপাস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক করা হয়।

সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সিলেট জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ফজলে রব্বে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে ফজলে রব্বেকে ঢাকায় প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরসংলগ্ন ছুটি, প্রশিক্ষণ ও প্রেষণজনিত সংরক্ষিত (সিভিল) পদে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে পদায়ন করা হয়।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.