August 23, 2025, 10:09 am


সামিউর রহমান লিপু

Published:
2025-08-23 05:02:17 BdST

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকারের অকাল প্রয়াননিখোঁজের একদিন পর মেঘনা নদী থেকে বিভুদা'র মরদেহ উদ্ধার


নিখোঁজের একদিন পর মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে দৈনিক 'আজকের পত্রিকা'র জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকারের (৭১) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।

শুক্রবার বিকেল ৫টা ৪৪ মিনিটে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. মাসুদ আলম এই বিষয়টি গনমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন। 

খবর পেয়ে বিভুরঞ্জনের স্ত্রী, পুত্র এবং ভাই চিররঞ্জন সরকারসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা মুন্সীগঞ্জের পথে রওনা হন। পরে সন্ধ্যায় তারা মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছে মরদেহটি শনাক্ত করে।

বিভুরঞ্জন সরকারের ছোট ভাই চিররঞ্জন সরকার বলেন, "ভাইকে নিতে মুন্সিগঞ্জে আসছি, পোস্টমর্টেম করে শনিবার দুপুরের পর মরদেহটি আমাদের কাছে দেওয়া হবে।"

শুক্রবার (২২শে আগষ্ট) বিকাল ৩টার দিকে গজারিয়ার চরবলাকী এলাকার মেঘনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় তার মরদেহ উদ্ধার করে কলাগাছিয়া নৌপুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা।

নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) সালেহ আহমেদ পাঠান বলেন, 'শুক্রবার বিকালে কলাগাছিয়া এলাকায় মেঘনা নদীতে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির মরদেহ ভাসতে দেখা যায়। নৌ পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যেয়ে মরদেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।

তিনি আরও বলেন, উদ্ধারের সময় সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরিকালে তার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মরদেহটি উপুড় হয়ে নদীতে ভাসছিল। গলায় তার চশমা ঝুলছিল।

তিনি আরও বলেন, 'রমনা থানায় করা জিডির সঙ্গে বিভুরঞ্জনের যে ছবিটি তার পরিবার দিয়েছিল, সেটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার পর বিষয়টি রমনা থানাকে নিশ্চিত করে মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ।'

লাশ উদ্ধারের ঘটনায় চরবলাকী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘শুক্রবার বাসা থেকে জুমার নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে মসজিদে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। পথে দেখলাম মেঘনা নদী থেকে আমাদের বাজারের দিকে যাওয়ার খালে এক ব্যক্তির লাশ ভাসছে। লাশটি উল্টো হয়েছিল। নামাজ পড়ে এসে দেখি উৎসুখ জনতার ভিড় জমে গেছে। পরে আমরা বিষয়টি পুলিশকে জানাই।

এই বিষয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদ আলম জানান, ‌‘মেঘনা নদীতে লাশ পাওয়া গেছে। আমরা মোটামুটি কনফার্ম হয়েছি। তার পরিবার গেলে শনাক্ত করে পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।'

বিভুরঞ্জন সরকার বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) সকালে অফিসে যাওয়ার কথা বলে বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে বের হন তিনি। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন ও ট্যাব বাসায় রেখে যান।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, বাসা থেকে বের হয়ে তিনি রাজধানীর মালিবাগের ফরচুন মার্কেটের সামনে আসেন। কিছুক্ষন পর এখান থেকে একটি বাইকে ওঠেন। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি।

এদিকে, বিকাল পাঁচটার মধ্যে তার বাসায় ফেরার কথা ছিল। পরে রাত ৯টায়ও বাসায় না ফেরায় বনশ্রীতে 'দৈনিক আজকের পত্রিকার অফিসে যেয়ে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কামরুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছেলে ঋত সরকার জানতে পারেন যে তিনি (বিভুরঞ্জন সরকার) অফিসে যাননি। গত ১৬ আগস্ট থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়েছেন তিনি।

এরপর বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তার কোনো তথ্য না পাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতেই রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ছেলে ঋত সরকার। শুক্রবার (২২শে আগষ্ট) রাতে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম ফারুক জিডির বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।

বিভুরঞ্জন সরকারের ছেলে ঋত সরকার এই প্রতিবেদককে বলেন, 'বাবা 'আজকের পত্রিকা'র জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত কলাম লিখতেন। গত ১৬ আগস্ট থেকে তিনি কর্মস্থলে সাত দিনের ছুটিতে ছিলেন। 

বিভুরঞ্জন সরকারের ভাই চিররঞ্জন সরকার এই প্রতিবেদককে বলেন, শুক্রবার বিকেলে রমনা থানার ওসির মাধ্যমে জানতে পাড়ি মেঘনা নদী থেকে একজনের লাশ পাওয়া গেছে। পরে ছবি দেখেই আমরা সন্দেহ করেছিলাম এটা দাদার লাশ হতে পারে। এখন আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি এটা দাদারই লাশ।

তিনি আরও বলেন, এমন ঘটনা কীভাবে ঘটল, এটি আত্মহত্যা না কি খুন, না পূর্বপরিকল্পিত সেই বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। শুধু এটাই বলব, এমন পরিণতি যাতে কারও না হয়।

১৯৫৪ সালে পঞ্চগড়ে জন্ম নেওয়া বিভুরঞ্জন সরকার ষাটের দশকের শেষদিকে স্কুলে পড়ার সময় দৈনিক আজাদে মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে লেখাপড়া করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে।

দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে তিনি কাজ করেছেন। দৈনিক মাতৃভূমি, সাপ্তাহিক চলতিপত্রের সম্পাদক এবং সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে লেখা তার রাজনৈতিক নিবন্ধ পাঠকপ্রিয় হয়।

ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিম কর্মী ছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী ছিলেন।

তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘বৃত্তবন্দি রাজনীতি’, ‘দোষারোপের রাজনীতি’, ‘আওয়ামী লীগ নিয়ে আশা ও আশঙ্কা’, ‘নানা চিন্তা নানা মত’, ‘কার চেয়ে কে ভালো’।

তার সম্পাদিত গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে- ‘কিবরিয়া স্মারকগ্রন্থ বক্তৃতা’, ‘কৃষক নেতা হাতেম আলী খান’, ‘মোনায়েম সরকার যখন নির্বাসনে’।

বিভুরঞ্জন স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বসবাস করতেন।

এদিকে, 'আজকের পত্রিকা'র জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৯টায় একটি নিবন্ধ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মেইল করেন।

ফুটনোটে তিনি লেখেন, ‘জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন। ’আমি বিভুরঞ্জন সরকার, দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। সাংবাদিকতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাঁচ দশকের বেশি সময়ের। দেশের নানা পরিবর্তন, আন্দোলন, গণআন্দোলন এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছি। এই দীর্ঘ সময় আমি লিখেছি সত্যের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। কিন্তু আজ, যখন নিজের জীবনকে দেখি, অনুভব করি সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।’

গতকাল শুক্রবার তার এই নিবন্ধটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়।

‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে সেই লেখায় তিনি নিজের ও ছেলের অসুস্থতা, মেডিক্যাল পাস সরকারি কর্মকর্তা মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় ‘ফেল করা’, বুয়েট থেকে পাস করা ছেলের ‘চাকরি না হওয়া’ এবং নিজের আর্থিক দৈন্যদশা নিয়ে হতাশার কথা লেখেন।

এছাড়া, প্রকাশিত এই নিবন্ধে উঠে এসেছে বর্তমান গণমাধ্যমের করুণ প্রতিচ্ছবি। নিদারুণ বাস্তবিকতায় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন- 'সংবাদপত্র আর কীভাবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াবে যখন ঘরের মধ্যেই রয়েছে অনিয়ম।'

তিনি আরও বুঝেছিলেন, 'সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।' হ্যাঁ এটাই বুঝি নিয়তি! আজীবন সৎ থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয় এমন হাজারো সৎ সাংবাদিককে।

রাষ্ট্র ও সাংবাদিকতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হতে হতে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত নিদারুণ কষ্ট, দুঃখবোধ, হতাশা এবং প্রচন্ড অভিমান নিয়েই বিদায় নিলেন তিনি। অনন্য এই কলমযোদ্ধার অকাল প্রয়াণে 'দ্যা ফিন্যান্স টুডে' পরিবারের পক্ষ থেকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা। অনন্তলোকে ভালো থাকুন আপনি।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.