September 10, 2025, 2:59 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-09-09 20:31:36 BdST

ইঞ্জিন সংকটে নাজুক রেল


দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গত দেড় দশকে রেলওয়ে দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঞ্জিন আমদানি করা হয়নি। ইঞ্জিনের অভাবে ট্রেন অপারেশন কার্যত স্থবির হয়ে পড়লেও মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের উদাসীনতায় সংকট উত্তরণের কোনো অগ্রগতি হয়নি।

রেল সূত্র জানায়, পূর্ব ও পশ্চিম দুটি অঞ্চলের দৈনিক ইঞ্জিনের চাহিদা প্রায় আড়াইশ হলেও দীর্ঘদিনের পুরোনো ইঞ্জিন ব্যবহারের কারণে প্রায় প্রতিদিনই ইঞ্জিন বিকল হওয়া, যাত্রা বিলম্বিত হওয়া কিংবা বাতিল হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে যেমন রেলের রাজস্ব আয় কমছে, তেমনি যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। পতিত সরকারের আশীর্বাদে পোস্টার কিছু কর্মকর্তা রেলের উন্নয়নে বাঁধার সৃষ্টি করছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ে ট্র্যাক, কোচসহ বিভিন্ন অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগ পুরোনো ধ্যানধারণায় অটল থেকে গেছে। নির্দিষ্ট সময়ে ইঞ্জিন আমদানি না করায় রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়েছে। সম্প্রতি ইঞ্জিন সংকটে সমালোচনা বাড়লেও বিভাগটি এখনো ইঞ্জিন বা যন্ত্রাংশ আমদানি করে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না।

এদিকে, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-আরএস) কোনো নির্দেশনা না মেনে অদৃশ্য শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে রেলওয়ে আরও সংকটে পড়েছে। তিনি পতিত সরকারের দোসর ছিলেন বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মোহাম্মদ সুবক্তগীন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে ইঞ্জিন সংকটে রয়েছি। ইঞ্জিন আমদানির একটি বড় প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল হওয়ায় সংকট শুরু হয়। বিদ্যমান ইঞ্জিনগুলো মেরামতের পাশাপাশি রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ৩০টি ইঞ্জিন আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে রেলের ইঞ্জিন সংকট কেটে যাবে।’

তিনি আরও জানান, রেল প্রশাসনে যে কোনো অনিয়ম ঠেকাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিয়মিত মনিটরিং করছে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে যান্ত্রিক বিভাগের দায়িত্বশীল অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরীর বিরুদ্ধে ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

সূত্রমতে, আহমেদ মাহবুব চৌধুরী ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তিনি রেলের ডিজিকেও থোরাই কেয়ার করেন।

রেলের ওয়ার্কিং টাইম টেবিল-৫৩ অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলে ২০২৩ সালে ৩টি ইঞ্জিন বাতিল হওয়ায় ১৫০টি ইঞ্জিন চালু আছে। প্রতিদিন ১১৬টি ইঞ্জিনের চাহিদার মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য ৭২টি, মালবাহীর জন্য ১৩টি, সান্টিংয়ের জন্য ১৬টি, শাটল ২টি, প্রকল্প ২টি এবং রিলিফ ট্রেন ও অন্যান্য কাজে ১১টি ইঞ্জিন প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরবরাহ পাওয়া যায় মাত্র ১০০টি। ফলে যাত্রীবাহী ১৬০টি এবং ৮টি কনটেইনার ট্রেন পরিচালনায় প্রতিটি ইঞ্জিনকে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩টি ট্রেনে যুক্ত করতে হয়। পুরোনো ইঞ্জিনের এই বাড়তি চাপ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করছে। এতে ট্রেনের গতি কমছে, বিকল হওয়ার ঘটনা বাড়ছে এবং সার্ভিসের মানও ক্রমশ নেমে যাচ্ছে।

একই অবস্থা পশ্চিমাঞ্চল রেলেও। এখানে দেড় শতাধিক ইঞ্জিনের মধ্যে প্রতিদিনের চাহিদা ১০০টিরও বেশি হলেও যাত্রীবাহী ট্রেনের জন্য ৬২টি, মালবাহীর জন্য ১৯টি, সান্টিংয়ের জন্য ৫টি, প্রকল্পে ৪টি, বিটি ২টি, রিলিফ ট্রেন বা আর্মি স্পেশাল ৩টি এবং পাইলট ট্রেনের জন্য ২টি ইঞ্জিন বরাদ্দ করতে হয়। অর্থাৎ, মোট ৮৭টি পাওয়া যায়। ২৮টি ইঞ্জিন মেইনটেন্যান্স স্পেয়ার হিসেবে রাখা হলেও বাকি ইঞ্জিনগুলো দিয়ে চাহিদার তুলনায় বেশি ট্রেন পরিচালনা করতে হয়। এতে পথের মধ্যে বিকল হওয়া ও শিডিউল ভঙ্গের ঘটনা বাড়ছে।

পূর্বাঞ্চলের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, ২০১১ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১১টি মিটারগেজ ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছিল। এরপর দীর্ঘ বিরতির পর ২০২১ সালে হুন্দাই রোটেম কোম্পানি থেকে ৩০টি আধুনিক প্রযুক্তির ইঞ্জিন আনা হয়। এসব ইঞ্জিন যুক্ত হওয়ার পর বহু পুরোনো ইঞ্জিন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় নতুন ৩০০০ সিরিজের কয়েকটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩০১৫ নম্বর ইঞ্জিনটি পাবর্তীপুরের কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানায় মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে এবং ৩০২৮ ও ৩০৩০ নম্বর ইঞ্জিন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী কারখানায় মেরামতাধীন আছে। ফলে নতুন ইঞ্জিনগুলো অকেজো হয়ে শপে আটকে থাকায় রেলের পরিবহন বিভাগ হিমশিম খাচ্ছে। এ ছাড়া অর্ধশত ইঞ্জিন মেরামতের জন্য বিপুল যন্ত্রাংশ প্রয়োজন হলেও বাজেট না থাকায় সংকট কাটছে না।

অভিযোগ রয়েছে, যান্ত্রিক বিভাগ ও রোলিং স্টকের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা ইঞ্জিন আমদানি না করে পুরোনো ইঞ্জিনগুলো মেরামত করেই সার্ভিস চালানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এসব ইঞ্জিন মেরামত বা ওভারহোল করার পর অল্পদিনের মধ্যে আবার বিকল হয়ে পড়ছে। নিম্নমানের যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপন এবং মেরামত কাজে গাফিলতির কারণে বারবার বিকলের ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ আছে। এর ফলে যাত্রীবাহী ট্রেনগুলো পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে, যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে ওঠে এবং নানা স্থানে বিক্ষোভ ও সংঘাতের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু কোন সুফল বয়ে আনেনি।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে সারা দেশকে রেল নেটওয়ার্কে আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে ইঞ্জিন আমদানি জটিলতার কারণে এর সুফল মিলছে না। ২০০৯ সালে ৭০টি ইঞ্জিন আমদানির একটি বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও ঋণের সুদহারসহ নানা জটিলতায় তা ভেস্তে যায়। এরপর ছোট ছোট প্রকল্পে ইঞ্জিন আনার পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী মিটারগেজ ইঞ্জিনের চাহিদা কমে যাওয়ায় আমদানির প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ছে। ফলে রেলওয়ে মূলত সর্বশেষ আনা ইঞ্জিনগুলোর ওপরই নির্ভর করছে।

রেলওয়ের একাধিক সূত্র জানায়, যান্ত্রিক বিভাগের অনিয়মের কারণে সরকার সরবরাহ কার্যক্রমে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। এতে রেল প্রশাসন আরও সংকটে পড়েছে। পরিবহন ও বাণিজ্যিক বিভাগগুলো যাত্রীসেবা ও আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করলেও যান্ত্রিক বিভাগের অসহযোগিতার কারণে তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সুপারিশ সত্ত্বেও নতুন ট্রেন চালুর উদ্যোগ ব্যর্থ হচ্ছে মূলত ইঞ্জিন ও কোচ সরবরাহ না পাওয়ায়।

সম্প্রতি রেলওয়ের একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে রেলের ইঞ্জিন সংকটের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। যেখানে দৈনিক কমপক্ষে ১৩ টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন সেখানে চলছে মাত্র ২টি। ভারতের ইন্ধনে বাংলাদেশ রেলওয়েকে ধ্বংসের গভীর চক্রান্ত চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে এক অস্বাভাবিক অচলাবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ভারতের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল পরিকল্পিতভাবে রেলকে ধ্বংস করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

লোকোমোটিভ মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের ঘাটতির কারণে বহু ইঞ্জিন বর্তমানে অচল অবস্থায় পড়ে আছে। এই অচলাবস্থার পেছনে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অভিযোগ রয়েছে, তিনি রেলওয়ের স্টোর এবং মেকানিক্যাল বিভাগকে দুর্বল করে একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছেন। ওয়ার্কশপগুলো প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের জন্য স্টোর বিভাগে চাহিদাপত্র পাঠালেও তা অনুমোদনের পর্যায়ে নানা প্রশ্ন ও অজুহাতে আটকে যাচ্ছে। এসব ফাইল যখন তার কাছে অনুমোদনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়, তখন তিনি তা ফেরত পাঠিয়ে দেন সিসিএস-এ তথাকথিত ‘কোয়ারি’র নামে। ফলে মালামাল সরবরাহ বিলম্বিত হচ্ছে, রক্ষণাবেক্ষণ থেমে যাচ্ছে এবং যাত্রীসেবায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।

রেলওয়ে সূত্রমতে, ডিজি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অতীতের ফ্যাসিবাদী শাসনের মতো রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা না করায় জিডি ষড়যন্ত্রের শিকার হচ্ছেন। তার উন্নয়নমূলক কাজ থামানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত পতিত সরকারের দোসররা। রেলে এখনো পতিত সরকারের আমলের দালালরা দলবদ্ধ হয়ে কাজ করছে।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.