April 26, 2024, 1:37 pm


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2020-08-15 05:53:16 BdST

জাতির পিতা হত্যাকাণ্ড: কাঠগড়ায় গণমাধ্যম


বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন আওয়ামী লীগে টইটুম্বুর। বর্ষায় বিলে যেমন মাছ কিলবিল করে, তেমনি বাংলাদেশের গণমাধ্যম জুড়ে এখন আওয়ামী বন্দনা এবং সব সাংবাদিকরাই যেন আওয়ামী লীগের সাংবাদিক।

এর মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় আছেন তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, আওয়ামী লীগের সৈনিক হিসেবে জাহির করে বিভিন্ন রকমের ফায়দা হাসিল করছে এরকম ঘটনা হরহামেশা ঘটছে। অনেক গণমাধ্যম কর্মী আওয়ামী লীগের থেকেও বড় আওয়ামী লীগার হয়ে গেছেন।

আগস্ট মাস আসলেই গণমাধ্যমগুলোতে শুরু হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর বন্দনা এবং নানারকম খবর-ফিচার-কলাম ইত্যাদি লিখে তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন।

কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। আমরা দেখি যে, ৭৫ এর ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে কেবল রাজনীতিবিদরাই অযোগ্যতার পরিচয় দেননি, প্রশাসনই কেবল কাপুরুষতার পরিচয় দেয়নি, বাংলাদেশের গণমাধ্যমও সীমাহীন ব্যর্থতা, দায়িত্বহীনতা এবং নতজানু সম্পাদকীয় নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ভোরে প্রকাশিত হয় ৪টি পত্রিকা। এই পত্রিকাগুলো ছিল ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ অবজারভার এবং বাংলাদেশ টাইমস।

এই পত্রিকাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, একটি দৈনিকও সাংবাদিকতার নূন্যতম নীতি-রীতি অনুসরণ করতে পারেনি।

১৯৭৫ এর ১৬ আগস্টে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাকের ৬ কলামের শিরোনাম ছিল- খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ। এই প্রতিবেদনের শুরুতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর ছাপিয়ে খন্দকার মোশতাক এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। সংবাদটির শুরুটা হয়েছিল এভাবে- রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসন ভার গ্রহণ করিয়াছে। এরপরে ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন। 

ছয় কলামের এই সংবাদটির পাশেই দৈনিক ইত্তেফাক দুই কলামে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ নামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল, যে সম্পাদকীয়তে এই ঘৃণ্য, নারকীয়, জঘন্য ঘটনাটিকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ঐসময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী এবং বার্তা সম্পাদক ছিলেন আসফ উদ দৌলা রেজা। উল্লেখ্য যে, দৈনিক ইত্তেফাকের মালিকদের মধ্যে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন খুনী মোশতাকের অন্যতম সহচর ছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনি মোশতাকের রাজনৈতিক দলও করেছিলেন। ঐদিনের দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় আরো যে খবরগুলো ছিল সেগুলোর শিরোনাম ছিল এরকম- উপরাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ, অচল নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত ফেরত, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শাসনভার গ্রহণ ইত্যাদি।

এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত ১৬ আগস্টের দৈনিক বাংলার আট কলামের শিরোনাম ছিল- খোন্দকার মোশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি। প্রধান এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা হয়েছে, শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ নামে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয় যেখানে এই খুনকে বৈধতা দেওয়া এবং খুনী মোশতাকের বন্দনা করা হয়েছিল।

দ্য বাংলাদেশ টাইমসের আট কলামের প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘মুশতাক অ্যাসিউমস প্রেসিডেন্সি’ এই শিরোনামের শোল্ডারে লেখা ছিল, ‘মার্শাল ল প্রক্লেইমড ইন দ্যা কান্ট্রি: মুজিব কিলড’।এখানেও একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল, ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’। আব্দুল গনি হাজারি সম্পাদিত পত্রিকাটিও অন্য তিন পত্রিকার মতো মোশতাক বন্দনায় মেতে ছিল।

ওবায়দুল হক সম্পাদিত ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের ১৬ আগস্টের প্রধান শিরোনাম ছিল- ‘মুশতাক বিকামস প্রেসিডেন্ট’। শিরোনামের শোল্ডার ছিল- ‘আর্মড ফোর্সেস টেক ওভার: মার্শাল ল প্রোক্লেইমড: কারফিউ ইমপোজড’। প্রতিবেদনটির নিচের অংশে ছিল, ‘মুজিব কিলড: সিচুয়েশন রিমেইনস কাম’।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কথা বলেন, যারা এখন বাংলদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয়, মত প্রকাশ করতে দেওয়া হচ্ছেনা বা গণমাধ্যম নানা রকম আইনকানুনের জালে বন্দি হয়েছে বলে বিভিন্ন ফোরাম থেকে কেবল বিভিন্ন সময় বক্তব্য রাখা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধেও কোন কোন মহল সোচ্চার।

যারা এই ধরণের মন্তব্য করছে এদের অনেকেই ৭৫ এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদিকতা করতেন। কিন্তু সেই সময়ে তাঁদের ভূমিকা কি ছিল তাঁদের স্বাধীন সাংবাদিকতা কোথায় ছিল সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।

শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালে, আজকের কাগজ প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যমই বঙ্গবন্ধু বা জাতির পিতা সম্বোধন করেনি, বরং শেখ মুজিবুর রহমান হিসেবেই তাঁকে সম্বোধিত করা হতো।

এখন ১৫ই আগস্টে যারা পাতায় পাতায় ক্রোড়পত্র করে, নানারকম ফিচার-প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেই পত্রিকাগুলোই ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত পেছনের পাতায় ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী’ শিরোনামে একটি ক্ষুদ্র খবর ছাপিয়েই ক্ষান্ত থাকতো।

কাজেই আমরা যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ কমিশন করবো, তদন্ত করবো, অনুসন্ধান করবো তখন অবশ্যই কাঠগড়ায় আমাদের গণমাধ্যমকেও দাড় করাতে হবে।

বিশেষ করে আজকে যারা স্বাধীন সাংবাদিকতা নেই বলে আহাজারি করে, তাঁরা সেদিন কোথায় ছিলেন সে প্রশ্ন উঠবেই।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা