May 21, 2024, 5:47 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2024-04-30 14:02:13 BdST

সোনালী লাইফে প্রশাসক নিয়োগে আইডিআরএ’র আদেশ সুপ্রিম কোর্টে বহাল


সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড করে প্রশাসক নিয়োগে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দেয়া আদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্ট।

সোমবার (২৯ এপ্রিল) বিচারপতি এনায়েতুর রহিমের চেম্বারে শুনানি শেষে এই আদেশ দেয়া হয়।

একইসঙ্গে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে পূণার্ঙ্গ শুনানি করে বিষয়টির নিষ্পত্তির আদেশ জারি করেছেন আদালত।

সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের ফলে সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বোর্ড স্থগিত ও প্রশাসক নিয়োগে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র দেয়া আদেশ কার্যকর থাকছে বলে জানিয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির পরিচালক ও মুখপাত্র জাহাঙ্গীর আলম।

এর আগে চলতি এপ্রিল মাসের ২১ তারিখ থেকে সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ ৬ মাসের জন্য সাসপেন্ড করে প্রশাসক নিয়োগ কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। সংস্থাটির পরিচালক (উপসচিব) আব্দুল মজিদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে গত ১৮ এপ্রিল এই তথ্য জানানো হয়।

প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করা হয় অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এম ফেরদৌস, এনডিসি, পিএসসিকে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর যতদ্রুত সম্ভব কোম্পানিটিতে দেশি বা বিদেশি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করে একটি পূর্ণাঙ্গ নিরীক্ষা সম্পন্ন করার পাশাপাশি বীমা পলিসি ইস্যুসহ কোম্পানির সকল কার্যক্রম পরিচালনা করার দায়িত্ব দেয়া হয় প্রশাসককে। 

দ্যা ফিন্যান্স টুডের একটি চৌকস টীম গভীর অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে, আইডিআরএ সোনালী লাইফের বরখাস্তকৃত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর রাশেদ বিন আমানের পেশ করা একটি রিপোর্টের ভিত্তিতে, অডিট ফার্ম হুদাভাসিকে দিয়ে সোনালীর কার্যক্রম ও লেনদেনের একটি অডিট করানো হয়। অডিট রিপোর্টটি সোনালী লাইফ কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর না করে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই সোনালীর বর্তমান বোর্ড ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।

সাবেক সিইওকে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের দায়ে বরখাস্ত করা হয়, এমনকি যার বিরুদ্ধে কোম্পানির মূল ডাটা ম্যানিপুলেশনের মতো এবং জাল শিক্ষাগত সনদ প্রদান করে সিইও পদে চাকরি নেওয়ার মতো অভিযোগ রয়েছে; যা ইতিমধ্যে প্রমাণিত হওয়ায় তিনি জেলও খেটেছেন। তার মতো একজন অপরাধীর উদ্দেশ্যমূলক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইডিআরএ তাদের নিয়োজিত অডিট ফার্মকে দিয়ে নিরীক্ষা চালায় এবং তার প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করেই সোনালীতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।

অভিযোগ উঠেছে যে, আইডিআরএ এমনকি অডিট ফার্মের অডিটের প্রতিবেদন কোম্পানি কতৃর্পক্ষকে সরবরাহ করেনি বা তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখিত বিষয় বা অভিযোগগুলো খণ্ডানোর কোনো সুযোগ না দিয়ে তড়িঘড়ি করে প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং গত ২১ এপ্রিল এই বিষয়ে চিঠি ইস্যু করে।

আইডিআরএ’র এই আদেশের বিরুদ্ধে একদিন পর হাইকোর্টে একটি রিট (নং-৪৫১৯/২০২৪) করেন বীমা কোম্পানিটির বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী মনিরুজ্জামান। রিটের শুনানি শেষে আদালত আইডিআরএ’র আদেশে ৬ মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন।

পরবর্তীতে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে চেম্বার জজের আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে পুনরায় রিট আবেদন করা হয়। আদালতে আইডিআরএ’র বক্তব্য শুনানি করে সোমবার (২৯ এপ্রিল) এই আদেশ দিয়েছেন।

এর আগে গত ৪ এপ্রিল এক চিঠিতে সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড করে কেন প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হবে না তার ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। ৫ কার্য দিবসের মধ্যে লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। একইসঙ্গে ১৮ এপ্রিল কর্তৃপক্ষে আয়োজিত এ সংক্রান্ত শুনানিতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।

এর আলোকে গত ১৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত শুনানিতে অংশ নেন সোনালী লাইফের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা। তবে এর আগের দিন ১৭ এপ্রিল কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদের ৩ জন পরিচালক পদত্যাগ করেন। এরা হলেন- আহমেদ রাজিব সামদানী, হুদা আলী সেলিম ও হাজেরা হোসেন।

প্রশাসক নিয়োগ সংক্রান্ত আইডিআরএ’র চিঠিতে বলা হয়, গত ১৮ এপ্রিলের শুনানিতে কোম্পানির পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান নূর-এ হাফজা পৃথকভাবে জবাব দাখিল করেন। আর বোর্ডের পক্ষে জবাব দাখিল করেন কোম্পানিটির বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী মনিরুজ্জামান।

কাজী মনিরুজ্জামানের জবাবে বলা হয়, কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস নিজে ও তার পরিবারের অনুকূলে ইস্যুকৃত শেয়ারের মূল্য, মাসিক বেতন গ্রহণ, তার নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অর্থ প্রদান, বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশে শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ব্যয় বাবদ অর্থ নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

তবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস দাবি করেন যে সোনালী লাইফের কাছে তার পাওনা ১৫৮ কোটি ৩৭ লাখ ২৩ হাজার ৩০৫ টাকা। এর মধ্যে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত অফিস ভাড়া বাবদ ১১৫ কোটি ৭৬ লাখ ৫৮ হাজার ৮শ’ টাকা, অফিস ভাড়ার বিলম্ব ফি বাবদ পাওনা ২৩ কোটি ১৩ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৬ টাকা, কোম্পানিকে ঋণ দেয়া বাবদ পাওনা ১০ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার ৯৪২ টাকা তিনি গ্রহণ করেছেন।

তবে মোস্তফা গোলাম কুদ্দুসের এই দাবির সাথে কোম্পানির বুক অব একাউন্টস, লেজার সিস্টেম জেনারেটেট ভাউচার, ব্যাংকের এডভাইস চেক ইত্যাদি ডকুমেন্টসের সাথে কোন মিল না থাকায় তার এই বক্তব্য গ্রহণ করা হয়নি আইডিআরএ’র শুনানিতে।

মূলত কোম্পানির টাকায় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিপুল ব্যয় বহন, নগদ গ্রহণ ও নিজ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তরের বিষয়টি উদঘাটিত হওয়ার পর তা ভাড়া হিসেবে গ্রহণের দাবি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রশাসক নিয়োগের চিঠিতে।

অপরদিকে নূর-এ হাফজা তার জবাবে বলেন, তার নামে ইস্যুকৃত প্লেসমেন্ট শেয়ারের মূল্য তিনি পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করেছেন। এছাড়া তিনি কোম্পানি থেকে যে পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছেন তা পরিশোধ করতে ইচ্ছুক বলেও জানান।

আইডিআরএ বলছে, অসম্পূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ বা তথ্য গোপন, অস্বচ্ছ হিসাবরক্ষণ পদ্ধতি, অভ্যন্তরীণ কন্ট্রোল সিস্টেমের অনুপস্থিতি, ক্যাশ চেকে বড় অংকের লেনদেন, এফডিআর জামানত রেখে বিপুল পরিমাণ ব্যাংক ঋণ গ্রহণ এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাসহ কোম্পানিটির ব্যাংক সিগনেটরির প্রায় সকলেই একই পরিবারের সদস্য।

এমন অবস্থায় সোনালী লাইফ কর্তৃপক্ষ বীমা কোম্পানিটির কার্যক্রম এমনভাবে পরিচালনা করছে যে, এতে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে কোম্পানি ও বীমা গ্রাহকদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে।

এর আগে সোনালী লাইফের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত করতে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর অডিট ফার্ম হুদাভাসী চৌধুরী এন্ড কোং-কে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওই তদন্তে ১৮৭ কোটি ৮৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৬৬ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ উঠে আসে।

ইদানীং কোন একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী নিয়ন্ত্রণ বা অনিয়ম হলে কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই সেখানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে অনভিজ্ঞ এবং অনভ্যস্ত একজন ব্যক্তিকে আর্থিক কোন প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার পর সাময়িক ভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে উক্ত প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়ে। অতীতেও একাধিক দপ্তর, অধিদপ্তর বা প্রতিষ্ঠানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কোন সুফল পাওয়া যায়নি। 

তারচেয়ে যদি সংগঠিত অনিয়ম বা দুর্নীতি নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় এনে পরিচালকদের মধ্য থেকে কাউকে দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানটি স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হতে পারে।

দেশের দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী বীমা প্রতিষ্ঠান সোনালী লাইফ গত ৩ মাসে নানান অস্থিরতার মধ্যেও ব্যবসায়ে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ সময়ে তারা ১১৪ কোটি টাকার বীমা দাবি পরিশোধ করেছে। এ অবস্থায় প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি গ্রাহকদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে বলে মনে করে সোনালী লাইফ।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা