January 15, 2025, 5:09 am


আবু তাহের বাপ্পা

Published:
2024-12-14 13:34:02 BdST

নজিরবিহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, তহবিল তসরূপ, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ একাধিক অভিযোগসিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী হত্যার মামলা


রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যার বিরুদ্ধে নবম শ্রেনীর এক ছাত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করেছে শিক্ষার্থীর পরিবার।

এছাড়াও তার বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, নিয়োগ বানিজ্য, তহবিল তসরূপ, স্বজনপ্রীতি,  শিক্ষকদের মাঝে গ্রুপিং সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষকদের উপর মানুষিক নির্যাতনের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে পতিত সরকারের পক্ষে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচেরও অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি, ঢাকার শাহজাহানপুর থানায় সন্তান হত্যার অভিযোগ নিয়ে গেলে প্রশাসনিক অসহযোগিতা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের কারনে মামলা করতে ব্যর্থ হন। পরে সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে সিএমএম কোর্টে শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যাকে একমাত্র আসামী করে মামলা করেছেন শাহানাজ বেগম নামে একজন শিক্ষার্থীর মা। মামলা নং ১৬১/২৪, ধারা ৩০৫, পেনাল কোড ১৮৬০। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

ভিকটিম ফারজানা আক্তার মৌ (১৪) সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী ছিলেন। সে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার হারাইরপাড়া এলাকার সৌদি প্রবাসী আবু মুসা ও শাহনাজ আক্তার মনির মেয়ে। এক ভাই দুই বোনের মধ্যে মৌ ছিল দ্বিতীয়।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, মামলার বাদী শাহনাজ বেগমের মেয়ে ফারজানা আক্তার মৌ (১৪) সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় জীববিজ্ঞান পরীক্ষার দিনে স্কুলের শিক্ষিকা আখি আক্তার খাতায় কয়েকটি দাগ কাটার অভিযোগে ফারজানার খাতা আটকে রাখে। ফারজানা প্রথমে শ্রেণী শিক্ষিকার কাছে, এরপর সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সবশেষে প্রধান শিক্ষকের কাছে খাতা ফেরত চেয়ে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ চায়। কিন্তু দুইঘন্টা পেরিয়ে গেলেও তাকে খাতা ফেরত দেননি প্রধান শিক্ষক।

উপায়ন্তর না পেয়ে ফারজানা পাগলের মতো ছুটে যান বাসায়। ফারজানার কান্না দেখে ও ঘটনার বিস্তারিত শুনে মামা মোস্তফা কামাল তাকে নিয়ে স্কুলে আসেন প্রধান শিক্ষকের কাছে সহযোগিতা কামনায়। মামা, ভাগ্নীর পরীক্ষা নেয়ার জন্য প্রধান শিক্ষককে বারবার অনুরোধ করেন। অবশেষে মাত্র ৩০ মিনিট সময় বেধে দিয়ে পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয় ফারজানাকে। কিন্তু অভিভাবককে স্কুলে ডেকে আনায় ফারজানার উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন প্রধান শিক্ষক। ফারজানার মামার সাথেও চরম দুর্ব্যবহার করেন প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্যা।

পরবর্তীতে, পরীক্ষার রেজাল্টে পরিকল্পিতভাবে কয়েক বিষয়ে ফারজানাকে অকৃতকার্য দেখানো হয়। আর এই ইস্যু সামনে এনে ফারজানাকে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করতে কোনভাবেই রাজি হননি প্রধান শিক্ষক।

মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ফারজানার মা শাহানাজ বেগম ও মামাসহ কয়েকজন আত্মীয় একাধিকবার আবেদন-নিবেদন করেন প্রধান শিক্ষকের কাছে। সর্বশেষ, মেয়ের উর্ত্তীনের আবেদনে সাড়া না পেয়ে পরীক্ষার খাতা পুন:মূল্যায়ন করতে অনুরোধ করা হয় অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। তাতেও কোন প্রকার সাড়া দেননি পাষণ্ড এই প্রধান শিক্ষক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মহত্যাকারী ছাত্রী ফারজানার বাবা সৌদি প্রবাসী। তাই মাকেই মেয়ের লেখা পড়াসহ সবকিছু করতে হতো। এদিকে, বাবা সৌদি প্রবাসী হওয়ায় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা রইসুল ইসলাম (ময়না) কে প্রধান শিক্ষক বলেন যে, মেয়েটির বাবা জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। এই কথা শোনার পর চেয়ারম্যান ময়না ফারজানাকে কোনভাবেই যাতে সুযোগ না দেয়া হয় সেজন্য কড়াভাবে নির্দেশ দেন। চেয়ারম্যানের নির্দেশ পেয়ে আরো কঠোর হয়ে ওঠেন প্রধান শিক্ষক শাহাবু্দ্দিন মোল্যা। পরে আবার ফারজানার মা মেয়ের বিষয়ে অনুরোধ নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে আসলে মেয়ের সামনে মাকে অকথ্য ভাষায় অপমান করেন প্রধান শিক্ষক। সেই সাথে ফারজানাকে দশম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করা হবে না বলেও সাফ জানিয়ে দেন। এতে চরম অপমানিত বোধ করে শিক্ষার্থী ফারজানা।

নিজের উপর হওয়া এই অবিচার এবং মায়ের অপমান কোনভাবেই মানতে পারেনি কিশোরী মেয়েটি। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে সকলের চোখ এড়িয়ে ঘরের দেয়ালে একটি সুইসাইড নোট লিখে বাসার ছাদ থেকে নীচে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে ফারজানা। ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে।

নিজের মৃত্যুর জন্য স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দায়ী করে সুইসাইড নোটে ফারজানা লিখেছিলো, "বাবা অনেক ইচ্ছা ছিল অনেক বড় হব, ভালো কিছু করব, কিন্তু হতে পারি নাই। মাফ করে দিও। আমি বাঁচতে চাইছি, কিন্তু আমাকে বাঁচতে দিল না। হেডমাষ্টারের ভাইয়ের মেয়ে ফেল করছে, তাকে ওঠানো হয়েছে, কিন্তু আমাদের হয়নি। আমার মৃত্যুর পর হলেও এর প্রতিশোধ নেওয়া হোক। ইতি, তোমার মা মৌ।

ওই সময় ফারজানার মা থানায় মামলা করতে গেলে প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চেয়্যারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা রইসুল ইসলাম ময়না থানায় হত্যা মামলা নিতে দেয়নি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আত্মহত্যার এই মামলাটিকে অপমৃত্যু হিসেবে দেখানো হয়। ইউডি মামলা নং (১৪/২০২২ইং), শাহাজানপুর থানা। এরপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মামলাটির চুড়ান্ত রিপোর্ট দিতে বাধ্য করে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে।

এই বিষয়ে জানতে শাহজাহানপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ও তদন্তকারী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সেদিন স্থানীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে মৌচাক মারুফ মার্কেটের পেছনে ২৩৭/২৩৮ নম্বর নকশি ভিলা নামে বাড়ির সামনে থেকে ওই স্কুলছাত্রীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। মেয়েটি ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার আগে বলপেন দিয়ে ছাদের বাউন্ডারী দেয়ালে একটি সুইসাইড নোট লিখে গেছে। সেখান থেকে বলপেনটি ও তার জুতা আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী এটি আত্মহত্যা বলে নিশ্চিত হই।

মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা অনেকদিন অস্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন। এনিয়ে ফারজানার সহপাঠীদের মাঝে ক্ষোভ থাকলেও নিজেদের নিরাপত্তা ও শিক্ষা জীবনের কথা চিন্তা করে এবং অভিভাবকদের চাপে তারা প্রতিবাদ করতেও সাহস পায়নি।

এদিকে, ফারজানার আত্মহত্যার পর তার পরিবারের সদস্যরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে যান। সেসময়ে স্কুলের কয়েকজন শিক্ষিকা এবং স্থানীয় ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি শাহাজানপুর থানার কয়েকজন পুলিশ সদস্যও বিষয়টি নিয়ে মুখ না খুলতে চাপ দেয় পরিবারটিকে। এই বিষয়গুলো জানা থাকায় বেশ ক্ষুব্ধ ছিলো ফারজানার কয়েকজন বান্ধবীসহ স্কুলের সহপাঠিরা।

গত ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ওইদিনই আত্মগোপনে চলে যান স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা রইসুল ইসলাম ময়না। চেয়ারম্যানের দোসর ও প্রেতাত্মা হিসেবে পরিচিত প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা স্কুল নিয়ে নতুন নাটক শুরু করেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও স্কুলে আওয়ামী শাসন বজায় রাখতে হীন ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেন শাহাবুদ্দিন মোল্যা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফারজানার হত্যার বিচারসহ স্কুলে নানা বৈষম্য, দুর্নীতি ও অন্যান্য অপকর্মের মূলহোতা হিসেবে প্রধান শিক্ষকসহ দুই সহকারি প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে নামে ছাত্রীরা।

এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সৃষ্ট অস্থিরতার নেপথ্য কারন অনুসন্ধানে যোগাযোগ করা হলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী এই প্রতিবেদককে বলেন, ছাত্রীদের আন্দোলন দমাতে কূট কৌশলের আশ্রয় নেন প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা। তিনি কৌশলে আন্দোলনরত ছাত্রীদের দাবিকে বিভক্ত করতে স্কুলের বাংলা মাধ্যমের ছাত্রীদের বিপক্ষে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রী-অভিভাবকদের লেলিয়ে দেন। আর ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রীদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান রইসুল ইসলাম ময়নার সকল দুর্নীতি ও নানা অপকর্মের প্রকাশ্য সহচর শ্যামা আক্তার, শিক্ষিকা নাসরিন সরকার, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা আমির হোসেন আমুর ভাতিজা বউ হিসেবে পরিচিত শিক্ষিকা মীর লাইজু হোসেন, সুমি আক্তারসহ আরও কয়েকজন।

সূত্র বলছে, বাংলা মাধ্যমের ছাত্রীরা আন্দোলনে তাদের সহপাঠী ফারজানার আত্মহত্যার জন্য প্রধান শিক্ষক এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাধা দেয়ার জন্য সহকারী প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন এবং তহবিল তসরুপসহ চেয়ারম্যানের পদলেহন করে যোগ্যতার বাইরে নানা সুযোগ সুবিধা গ্রহণ ও স্কুলের স্বার্থক্ষুন্নের অভিযোগে ইংরেজি মাধ্যমের সহকারী প্রধান শিক্ষিকার পদত্যাগের দাবি সামনে আনে।

ফারজানার আত্মহত্যার বিষয়টি যাতে সামনে না আসে সেজন্য আন্দোলন থামাতে বাংলা মাধ্যমের ছাত্রীদের উপর আক্রমনের গোপন নির্দেশ দেন প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা।

সূত্র মতে, আন্দোলনের সময়ে অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে কোন প্রকার আলোচনা না করেই ছাত্রীদের উপর আক্রমনের নির্দেশ দিয়ে গোপনে স্কুল ক্যাম্পাস ত্যাগ করে চলে যান প্রধান শিক্ষক। এই সময়ে স্কুলের বাংলা মাধ্যমের ছাত্রীদের উপর পাশবিক আক্রমন চালায় প্রধান শিক্ষকের লেলিয়ে দেয়া গুন্ডাবাহিনী। প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে গুন্ডাবাহিনীর নারকীয় আক্রমনে মারাত্মকভাবে আহত হয় স্কুলের অনেক ছাত্রী। এদের মধ্যে ৬ জনকে তখন স্থানীয়  হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আহত ছাত্রীদের হাসপাতালে দেখতে যাওয়া বা ঘটনাপরবর্তী সময়ে তাদের কোন প্রকার খোঁজ খবরও নেননি প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা। আহতদের মধ্যে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার চেষ্টা করে প্রধান শিক্ষকের লেলিয়ে দেয়া গুন্ডা বাহিনী। ছাত্রীদের উপর ঘটে যাওয়া এই পাশবিক ঘটনায় কোন আইনী প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাও নেননি বিতর্কিত এই প্রধান শিক্ষক।

সূত্র বলছে, এতসব ঘটনার সব প্রমাণ স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজে থেকে যাওয়ায় ফুটেজটি নিজের লোকের মাধ্যমে সরিয়ে নেন প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্যা। এরপর তিনি প্রচার করতে থাকেন সিসিটিভি ফুটেজ চুরি হয়ে গেছে।

এদিকে, প্রধান শিক্ষকের সকল অপকর্ম এবং ছাত্রী নির্যাতনের নেপথ্য খলনায়ক হিসেবে প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যার বিচার চেয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও সিদ্ধেশ্বরী স্কুলের বর্তমান গর্ভনিং বডির চেয়ারম্যান বরারর আবেদন করেছেন শ্বাসরোধে হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর মা শামসুন্নাহার।

গত ১৮/০৯/২০২৪ ইং তারিখে এই অভিযোগ জমা দেন তিনি। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন যে, তার মেয়েকে নির্মমভাবে হত্যাচেষ্টার ব্যাপারে তিনি বা তার পরিবারের কেউ যেন কোনপ্রকার আইনী পদক্ষেপ না নেন। প্রতিনিয়ত তাকে প্রধান শিক্ষকের পক্ষ থেকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। উক্ত অভিযোগপত্রে ০১৭০৬৯৭১১৬৯ মোবাইল নম্বর থেকে তাকে হুমকি দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।

প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির যত অভিযোগ

বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা এক কোটির বেশি পরিমাণ টাকা পিপলস লিজিং কোম্পানিতে জমা দিয়েছিলেন। যার কোন হদিস এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কোম্পানিটি দীর্ঘদিন যাবৎ উধাও। ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা ফার্স্ট ফিনান্স নামে অপর একটি লিজিং কোম্পানির কাছে জামানত রেখেছে যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এই টাকা উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব।

বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্কুলের পশ্চিমপাশের দোতলা একটি ভবনকে ৪ তলায় উন্নীতকরনে এক কোটি ৫০ লক্ষ টাকার মত দুর্নীতি হয়েছে। শতবর্ষী এই স্কুলটির সীমানা প্রাচীর ঘেষে এবং সম্মুখসারিতে বিভিন্ন ফলজ এবং বনজ কাঠের গাছ ছিল যেগুলো শাহাবুদ্দিন এবং ময়না মিলে বিক্রি করে দিয়েছেন।

স্কুলের পূর্বপাশে রাস্তার উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ৭০০ ফিটের মত প্রশস্ত ২ ফিট করে জায়গা গাজী গোলাম দস্তগীরের কাছে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে মৌখিকভাবে বিক্রি করে দিয়েছেন। ফলে স্কুলের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে দস্তগীর গাজীর বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা প্রশস্থ করা হয়েছে।

বিদ্যালয়ের কেনাকাটায় নজিরবিহীন দুর্নীতি

সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ব্যবহারের জন্য ২০১৯ সালে একটি জেনারেটর কেনা হয়েছিল যা ছিলো পুরনো। জেনারেটরটি কেনার পর একদিনও ব্যবহার করা যায়নি। এমনকি ক্রয়মূল্য কোম্পানিকে পরিশোধ করার পর প্রদত্ত রসিদ বিদ্যালয়ের হিসাব শাখায় জমা না দিয়েই এবং জেনারেটরটি নতুন কেনা হয়েছে দেখিয়ে বিল প্রদান করা হয়। মূলত পারস্পরিক যোগসাজশ করে দুর্নীতির মাধ্যমেই জেনারেটর ক্রয়ের সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।

নতুন জেনারেটর ক্রয় বা নতুন লিফট ক্রয়সহ বিদ্যালয়ের সকল প্রকার কেনাকাটাতেই নজিরবিহীন দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত সমুদয় অর্থ ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেন।

চলমান নানা অনিয়ম

সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের ভিতরে স্থাপিত ক্যান্টিনের ভাড়া ব্যাংকের হিসাব শাখার ফান্ডে জমা করা হয় না। স্কুলের নামে থাকা একটি ফ্ল্যাটের ভাড়াও গোপন চুক্তির মাধ্যমে গ্রহন করা হয়। সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের নামে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে খোলা হিসাব থেকে প্রায়শই অপ্রয়োজনে টাকা উত্তোলন করা হয়।

স্কুলের ভিতরে ছাত্রীদের বসার জন্য বানানো সুন্দর সুন্দর বেঞ্চ হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান ময়নার বউয়ের জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী পালনে রান্না করার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। পরে প্রায় ২০০ জোড়া অতিরিক্ত বেঞ্চ বানানো হয়েছে। অপ্রয়োজনে বিদ্যালয়ের ফ্যান পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে বছরে কয়েকজন শিক্ষকের বেতন কয়েকবার বৃদ্ধি করা হয়েছে।

অভিযোগ আছে, শিক্ষকদের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই টাকা মাস শেষে উত্তোলন করে শিক্ষকরা ময়না, শাহাবুদ্দিন, দেলোয়ার এবং শামীম শামাকে দিয়ে দিতেন। বিভিন্ন সময় অপ্রয়োজনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

নিয়োগ বানিজ্য

শিক্ষক নিয়োগের নামে বাণিজ্য করা হয়েছে লাখ লাখ টাকা। নামমাত্র পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাস্থান থেকে কোন প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। টাকার বিনিময়ে নিম্ন নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দৈনন্দিন খরচের নামে বিশাল অংকের বাজেট দেখানো হতো। ওই টাকা দিয়ে চেয়ারম্যান ও প্রধান শিক্ষকের বাসার বাজার করা হতো।

স্বজনপ্রীতি

ইংরেজী মাধ্যমের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সিদ্বেশরী গার্লস স্কুলের সাবেক সভাপতি শেখ রঈসুল আলম ময়নার ছেলে শেখ ইমরানুল আলম। বিগত ১৫ বছর যাবৎ সম্মানী ভাতা হিসেবে ৪২ হাজার করে ২০২৪ এর জুলাই মাস পর্যন্ত টাকা নিয়েছেন।

সিদ্বেশরী গার্লস স্কুলের  দুইজন বুয়া (জুঁই ও শেফালী) নিয়োগ দেয়া হলে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান শেখ রঈসুল আলম ময়নার বাসায় তারা কাজ করে আসছে ১৫ বছর যাবৎ। এমনকি শেফালীকে কোন নিয়মনীতি ছাড়াই এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে অবৈধ বলে বিবেচিত হয়েছে।

শেখ রঈসুল আলম ময়নার ড্রাইভার, দুই বুয়ার বেতন, উত্তরায় জায়গার পাহারাদার মোহাম্মদ হোসেনের বেতনও দেয়া হচ্ছে স্কুল ফান্ড থেকেই।

অনিয়ম

নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রায় ৩৫ জনের মতো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিধিমালা অনুযায়ী এই নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ, সাক্ষাৎকার গ্রহন ও সম্পন্ন করতে সরকার থেকে (বোর্ড) কোন প্রতিনিধি আসেনি। স্কুলের শিক্ষকদের দিয়ে প্রশ্ন করিয়ে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

৪/৫ বছর আগে যে সকল শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তাদের নিয়োগপত্র (অস্থায়ী) ১৫/২০ দিন আগে দেওয়া হয়েছে। জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পেতে এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে।

তহবিল তসরূপ

স্কুলের ফান্ডে জমে থাকা ২১ কোটি টাকা থেকে লিফট, জেনারেটর ক্রয় বাবদ এবং কিছু টাকা বকেয়া বিল দেখিয়ে শেখ রঈসুল আলম ময়না, প্রধান শিক্ষক, দুই সহকারী প্রধান শিক্ষক মিলে মোটা অংকের অর্থ নিজেরা আত্মসাৎ করেছেন। পিপলস্ লিজিং কোম্পানিতে এক কোটি টাকা আছে। এছাড়া ইউসিবি এবং ফার্স্ট ইসলামী ব্যাংকসহ আরো ৯টি ব্যাংকে টাকা আছে। এই তহবিলের বিষয়ে অবগত আছেন প্রধান শিক্ষক ও দুই সহকারী প্রধান শিক্ষক।

শেখ রইসুল আলম ময়নার বাসায় প্রতিদিন স্কুল থেকে টাকা উঠিয়ে বাজার করে নিয়ে যেত শিক্ষক মাওলানা সাঈদুর রহমান। উনি স্কুলে ক্লাস না করিয়ে মাসের পর মাস বেতন নিচ্ছেন। শেখ রইসুল আলম ময়নার পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতো এবং রাতের অন্ধকারে দুই বছর পর পর কমিটি বানিয়ে আনতো এবং শিক্ষা বোর্ডকে কিনে নিয়েছিল টাকার মাধ্যমে। স্কুলের পঞ্চম, অষ্টম, নবম, দশম শ্রেণীর মেয়েদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ১২০০ টাকা করে হাতিয়ে নিতেন কোচিংয়ের নামে। অনেক পরিবার আছে যারা টাকা দিতে পারবে না অথবা কোচিং করতে চাইতো না তাদের বিভিন্ন ভয় দেখিয়ে শ্রেণী!  দিয়ে টাকা নেওয়া হতো। আর মেয়েরা স্কুলে না আসলে (অসুস্থ থাকা অবস্থায়) একদিনে অনুপস্থিত ফি নেয়া হয় পঞ্চাশ টাকা করে।

এভাবে দেখা গেছে, প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা অনুপস্থিত ফি প্রধান শিক্ষক ও দুই সহকারী প্রধান শিক্ষক এবং সভাপতিসহ সবাই ভাগ করে নিতেন।

সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ দেলোয়ার হোসেন স্কুলের শিক্ষিকাদের মধ্যে গ্রুপিং করে স্কুলের নিয়োগ, পরীক্ষা, কোচিং এর ক্লাস এগুলো পরিচালনা করেন। কোচিংয় থেকে পদত্যাগ  বিরাট অংশ তারা ভাগাভাগি করে নিত আর সামান্য টাকা শিক্ষকদের দিতেন।

স্কুলে সংগঠিত দুর্নীতির প্রধান হোতা মোঃ দেলোয়ার হোসেন ১৩ জন শিক্ষককে ডিঙিয়ে এবং পরীক্ষা ছাড়াই সহকারী প্রধান শিক্ষক হন সভাপতির মাধ্যমে। তদন্ত করলেই সব বেরিয়ে আসবে।

ছাত্রী হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগের বিষয় নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমি এসব কিছুর সাথে জড়িত নই। ছাত্রী ফারজানা আত্মহত্যা করেছে এজন্য আমি খুব দুঃখিত। ফারজানার অপমৃত্যুতে আমি ভীষণভাবে দুঃখ পেয়েছি।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা বলেন, লিজিং কোম্পানিতে টাকা রাখা হয়েছে আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক সই নিয়ে। তিনি নিজেকে ধোয়া তুলশি পাতা দাবি করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এই বিষয়ে অবগত আছেন ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা ও দুই সহকারী প্রধান শিক্ষক।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা আমির হোসেন আমুর ভাতিজার স্ত্রী শিক্ষিকা মীর লাইজুর মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওযা যায়।

সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহাবুদ্দিন মোল্ল্যা এবং ম্যানেজিং কমিটির কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে উত্থাপিত সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতি, নিয়োগ বানিজ্যসহ অন্যান্য অভিযোগের ব্যাপারে জানতে সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান শেখ রঈসুল আলম ময়না, সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ দেলোয়ার হোসেন সহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সাথে কথা বলতে একাধিকবার ফোন করা হলেও কেউ কথা বলেননি।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.