September 13, 2025, 12:11 am


ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন

Published:
2025-09-12 21:38:03 BdST

অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা ও ঢাবি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নডাকসু নির্বাচন: ছাত্রদলের আত্মসমীক্ষা জরুরী


বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ ছয় বছর পর হওয়া নির্বাচনে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা প্রবল উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার সঙ্গে তাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে ভূমিধস জয় পেয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল। ভিপি, জিএস, এজিএসসহ ২৮ পদের ২৩টিই দখলে নিয়েছে তারা। অন্যদিকে ভরাডুবি হয়েছে ছাত্রদলের প্যানেলের। একটি পদও পায়নি তারা।

ডাকসুর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে বিশাল আলোচনার ঝড়। অনেকেই এটিকে জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখছেন। তবে ডাকসুকে “দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট” ভেবে বিভ্রান্ত না হয়ে এখান থেকে শিক্ষনীয় দিকগুলো খুঁজে বের করা এবং ছাত্র সংগঠনগুলোকে নতুন বাস্তবতার জন্য সুসংগঠিত করা এখন সবচেয়ে জরুরি।

ছাত্রদল আবিদুল ইসলাম খানের মতো একজন ভার্সেটাইল নেতাকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। এই সত্যটা মানতে হবে। এত বড় একটা সংগঠনের ভিপি প্রার্থীকে অন্তত কয়েকমাস আগে মাঠে নামাতে হতো যাতে করে সবাই তার কাজকর্ম সম্পর্কে জানতে পারতো। আবিদুল ইসলাম খানকে ছাত্রদল কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধের মাঠে নামিয়ে দিয়েছে। এটি তাদের অনেক বড় সাংগঠনিক ব্যর্থতা এবং অদূরদর্শীতা।

ছাত্রদলের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আহ্বান, আগামী ১ বছর তারা যদি শিক্ষার্থীদের জন্য সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে, তবে সামনের ডাকসু নির্বাচনে আরও ভালো করতে পারবে। তাদেরকে জয়-পরাজয় মেনে নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে হবে।

সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখে যারা কাজ করতে পারবে, তারাই হবে প্রতিনিধি। সে যেই দলের রাজনীতিই করুক না কেন। এই বিষয়ে রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রসংগঠনগুলোকে আরও সচেতন হতে হবে বলে মন্তব্য তাদের।

সার্বিক বিবেচনায়, সময় হয়েছে ছাত্রদলের রাজনীতি নতুনভাবে নির্মাণ করার। পুরনো ধাঁচের রাজনীতি শিক্ষার্থীরা প্রত্যাখ্যান করেছে।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (ছাত্রদল) এর জন্য এই নির্বাচন একটি আত্মসমীক্ষা ও নতুন করে সংগঠন পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি করেছে।

ছাত্রদলের SWOT বিশ্লেষণ

শক্তি (Strengths):

• শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও বিএনপির আন্দোলনমুখী রাজনীতির উত্তরাধিকার।
• ১৭ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা।
• শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে গণতন্ত্র ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতি আকাঙ্ক্ষা।

দুর্বলতা (Weaknesses):

• সাংগঠনিক ভাঙন ও মাঠপর্যায়ে ঐক্যের অভাব।
• আধুনিক রাজনৈতিক কৌশল, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উপস্থিতি ও প্রচারণায় সীমাবদ্ধতা।
• নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনীর মধ্যে প্রজন্মগত সমন্বয়ের ঘাটতি।

সুযোগ (Opportunities):

• অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা।
• জাতীয় রাজনীতিতে নতুন করে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ।
• ছাত্রসমাজের প্রকৃত সমস্যাগুলো নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ (ফি, সেশনজট, কর্মসংস্থান)।

হুমকি (Threats):

• প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের প্রশাসনিক প্রভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা।
• অনিয়ম, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির পুনরাবৃত্তি।
• তরুণ সমাজের রাজনৈতিক বিমুখতা ও হতাশা।


ছাত্রদলের করণীয় উন্নয়ন কৌশল

সংগঠন পুনর্গঠন – কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কাঠামো শক্তিশালী করা।

ডিজিটাল উপস্থিতি বাড়ানো – অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কার্যকর প্রচারণা চালানো

বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা – সেমিনার, বিতর্ক, গবেষণাভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার।

আদর্শভিত্তিক আন্দোলন – দুর্নীতি, বৈষম্য ও স্বৈরতন্ত্রবিরোধী অবস্থানকে তরুণ সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য করা।

সমস্যাভিত্তিক রাজনীতি – শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর প্রস্তাবনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ।

অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতা ও ঢাবি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা

ডাকসুর নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাটতি:

• ভোটকেন্দ্রে কার্যকর নজরদারি ও স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ব্যর্থতা।

• দুর্নীতিবাজ ও প্রভাবশালী চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া।

• প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতা।
• নির্বাচনী অনিয়মে দায়ীদের দ্রুত বিচারের আওতায় না আনা।

ঢাবি কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্য বিভ্রান্তি বা ত্রুটি:

• প্রার্থীদের প্রচারণায় পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ

• নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দুর্বলতা

• ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ঠেকাতে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও উদাসীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের করণীয়:

• স্বাধীন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা

• ডিজিটাল ভোটিং ও বায়োমেট্রিক সিস্টেম চালু করা

• নির্বাচনী অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা

• বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনা

উপসংহার

ডাকসু নির্বাচন একদিকে ছাত্র সংগঠনগুলোর সক্ষমতা যাচাইয়ের ক্ষেত্র, অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ চিত্রও প্রতিফলিত করে। এই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাত্রদল যদি সংগঠন পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নে মনোযোগ দেয়, তবে তারা অচিরেই জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিতে পারবে।

অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণের আস্থা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে।

লেখক বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত নিউ হোপ গ্লোবালের চেয়ারম্যান এবং একজন কলামিস্ট, আন্তর্জাতিক গবেষক, মানবাধিকার সংগঠক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.