September 27, 2025, 1:51 am


নেহাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক

Published:
2025-09-26 19:23:35 BdST

চেতনার ছন্দে, অবহেলার ছায়ায় ঢাকিরা


বাংলার পূজা-পার্বণে ঢাকির ভূমিকা অপরিসীম। দুর্গাপূজা, কালীপূজা, শারদোৎসব কিংবা গ্রামীণ যাত্রাপালা—সবকিছুতেই ঢাকের বাদ্য যেন উৎসবের প্রাণস্বরূপ। ঢাকের আওয়াজ ছাড়া পূজা যেন প্রাণহীন হয়ে পড়ে। দেবীর আগমনী বার্তা থেকে বিসর্জন—প্রতিটি মুহূর্তেই ঢাকিরা ছন্দে-তালে উৎসবকে জাগ্রত করে তোলে।

আশ্বিনের গা শিরশিরে হালকা শীতের ভোরবেলা। উঠোনে পা দিতেই দেখা মেলে কুয়াশা মেশানো শিউলিতলা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ জানান দিল সময় সমাগত।

শারদীয় দুর্গাপূজার সময় ঢাকিদের চাহিদা সর্বাধিক থাকে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত মণ্ডপে মণ্ডপে তাঁদের ডাক পড়ে। অনেক ঢাকি আগেই চুক্তিবদ্ধ হয়ে যান, কেউ কেউ এক মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপে ঘুরে বেড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।

ঢাকিরা শুধু বাদ্য বাজান না, তাঁরা মূলত আবহ তৈরি করেন। আগমনী সুরে মানুষের মনে আনন্দ জাগে, বিসর্জনের সুরে বুক ভরে ওঠে বেদনায়। পূজার আনন্দকে প্রাণবন্ত করার এই ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ঢাকিরাই বয়ে নিয়ে চলেছেন।

পাড়ায় ঢাক বাজলেই বিয়ে, অন্নপ্রাশন কিংবা পূজা... এই আনন্দের বাজনা নিয়েই ঢাক আর ঢাকিরা হাজির হতেন। পাড়ার কচিকাচারা ঢাকের আওয়াজ শুনলেই জমাত ভিড়৷ বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের আমোদের সীমা নেই। কারণ ঢাক বাজলেই পড়াশুনো থেকে কদিনের জন্যে ছুটি, ঢাক বাজলেই নতুন জামা।

ঢাক যেন সব পেয়েছির দেশের সেই ইচ্ছে বুড়ো। ঢাকে কাঠি পড়লেই যা চাওয়া যায় তাই মিলে যায়। বাড়ির সব থেকে রাগী ঠাকুমা, পিসিমার দলেরও মন নরম হয় ঢাকের বোলে। আহা, কী সব দিন! সেইসব দিনে ঢাকিদের বায়নাও ছিল তেমনি৷ অন্তত দুমাস আগে বায়না দিয়ে রাখতে হতো। নইলে পাওয়া মুশকিল। তা হবে নাই বা কেন? এখন যেমন বিয়েবাড়ি মানেই সাউন্ড বক্স, গানবাজনা, ডিজে—তখন ছিল ঢাক-বাঁশি-সানাইয়ের দিন।

ঢাকের আড়ালে মধ্যযুগীয় বর্বরতার নির্মম ইতিহাস

তবে ঢাক যে শুধু আনন্দের বাজনা তা কিন্তু নয়।ঢাকের আনন্দময় শব্দের পেছনে লুকিয়ে আছে সতীদাহ প্রথার নির্মম ইতিহাস। আছে নাবালিকা অসহায় বিধবার বাঁচতে চাওয়ার আকুল আর্তনাদ চাপা দেওয়ার চেষ্টা। আশ্চর্য হচ্ছেন? আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি বটে।

প্রাচীন ভারতবর্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এক ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন লৌকিক প্রথা চালু ছিল, যেখানে স্বামীর চিতায় স্ত্রীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো এবং এই প্রথার সপক্ষে রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, স্বামীর সাথে স্ত্রীর সহমরণ মানে নিশ্চিত স্বর্গলাভ। অথচ ভেতরকার উদ্দেশ্য ছিল বিধবার সম্পত্তি ও স্ত্রীধন আত্মসাৎ।

যতই পরলোকে স্বর্গপ্রাপ্তির প্রলোভন দেখানো হোক না কেন, খুব কম নারীই নিজ ইচ্ছায় গনগনে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে সম্মতি জানাতেন। আর যখনই অসম্মতি, তখনই শুরু হতো জোরজবরদস্তি। যারা সহমরণে যেতে চাইতেন না, তাদের প্রতি চলতো জোর-জুলুম। জীবিত অবস্থায় চিতায় ওঠার আগে এই সমস্ত নারীর কান্না আর আর্তচিৎকারে সৃষ্টি হতো এক ধরনের গোলমেলে পরিস্থিতি। এই হই হট্টগোল ধামাচাপা দেওয়ার জন্যেই সতীদাহের সময় আয়োজন করা হতো ঢাকের মতন বাদ্যযন্ত্রের। উৎসবের আওয়াজের আড়ালে এমনিভাবে চলেছে মধ্যযুগীয় বর্বরতাও।

ঢাক যেমন করে এলো

সংস্কৃত শব্দ ঢক্কা থেকে ঢাক শব্দটি এসেছে। প্রাচীনকালে যুদ্ধের সময় সৈন্যদের মনোবল অটুট রাখতে বাজানো হতো ঢাক। মহাভারতে উল্লেখিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও ঢাক বাজানোর প্রমাণ মেলে। আবার হিংস্র পশুপাখির হাত থেকে বাঁচতে ঢাক ব্যবহার করা হতো। এমন কী, বলিদানের অনুষ্ঠানে বাজানো হতো ঢাক। ঢাকের নানা ধরন-ধারণও ছিল। জয় ঢাক থেকে শুরু করে বাওতি ঢাক, বৌ ঢাক, বীর ঢাক, মেঠো ঢাক ছিল প্রচলিত। শুধু যে নামের বাহার তা কিন্তু নয়, একেক ঢাকের বোল একেকরকম, বানানোর ও বাজানোর রীতিতেও আছে বিস্তর ফারাক।

মনে করা হয়ে থাকে, ঢাকের ইতিহাস প্রায় তিন হাজার বছরের পুরোনো। ঢাকের উৎপত্তিস্থল হিসেবে মনে করা হয় মূলত বাংলা ও আসামকে। পূর্ববঙ্গে জন্ম হলেও আস্তে আস্তে প্রাচীন ভারতবর্ষের নানান লৌকিক উৎসবে প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে এই ঢাক। পলাশী যুদ্ধে জয়লাভের জন্য লর্ড ক্লাইভের সম্মানে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব আয়োজন করেছিলেন বিজয় উৎসবের। সেই উৎসবে ঢাক বাজিয়েছিলেন নদীয়ার ঢাকিরা।

আমাদের ছোটোবেলায় 'আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে ডাক, ঢোলঢোল ঝাঁঝর বাজে' ছড়াখানা ছিল বেশ জনপ্রিয়। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া এই ছড়াতেও ঢাকের উল্লেখ বাঙালির নিত্যজীবনের সাথে ঢাকঢোলের নিবিড় সম্পর্ককে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। গ্রামবাংলার লাঠিখেলা, কবিগানসহ নানা ধরনের আয়োজনে ঢাক ঢোল কাঁসা থাকবেই। শুধু কী তাই? যাত্রাপালাতেও বিভিন্ন দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে ঢাক বাজানো হতো৷ ঢাকঢোল পেটানো, নিজের ঢাক নিজে পেটানোর মতন নানা প্রচলিত প্রবাদে বাঙালি সংস্কৃতিতে ঢাকের সম্পৃক্ততা ঠিক কতখানি তা আন্দাজ করা যায়।

ঐতিহ্যবাহী সেই ঢাকের প্রচলন রয়ে গেছে আজও। তবে কমেছে ঢাক আর ঢাকির সংখ্যা। পেশাদার ঢাকিদের পেটের প্রয়োজনে নিতে হয়েছে অন্য পেশা।

কাগজে কলমে ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ ঘটলেও ব্রিটিশের তৈরি এই সামন্ত প্রভুরা তখনও বাংলাদেশের (পূর্ব বাংলা) আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। জমিদারবাড়ির উৎসব মানে জাঁকজমক থাকা চাই, বাজনা বাদ্যি থাকা চাই। বায়নার টাকা তো আছেই, পাশাপাশি যে-কদিন ঢাক বাজানোর চুক্তি, সে-কদিন থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত। খই, নাড়ু, বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি, ঘিয়ে ভাজা লুচি, আরো কত কী খাবার!

সেই আমলে অত্যাচারী জমিদার যেমন ছিলেন, তেমনি শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক জমিদারও ছিলেন। এসব শিল্প সমঝদার জমিদার শিল্পীর মর্যাদা দিতে জানতেন। তাই শিল্পী সে যেই হোক, দিতেন যোগ্য সম্মানী। সমাদর তো আছেই।

নানা ধরনের বই কিংবা সিনেমায় ঢাক আর ঢাকিকে যত ঐশ্বর্যমণ্ডিত করে দেখানো হয়, এদের অবস্থা ঠিক তেমন নয়। খুবই সাধারণ এই ঢাকিরা। তবে এই ঢাকিদের বাদ্যি আছে, বাজনা আছে, হাতের এলেম আছে। মনের মধ্যে ঢাকের তাল আছে। আগে উৎসব এলেই ঢাকের জামা বদলাতো, উৎসবের রঙে সেজে উঠতো ঢাক। পূজা এলেই ঢাকের সাথে কাশফুল জুড়ে ঢাকের নয়া শারদ সাজ। এখন ঢাকেরও নেই সেই সাজপোশাকের বালাই। ইচ্ছে থাকলেও উপায় তো নেই। ঢাক সাজিয়ে তোলবার মতন টাকাও থাকা চাই।

কেমন যাচ্ছে ঢাকিদের জীবন

বাংলাদেশে সারাবছর ঢাকিরা অবহেলিত, অনাদৃত হয়ে পড়ে থাকেন। থাকেন আলোচনার বাইরে। শারদ উৎসব এলে তখন তাদের ডাক পড়ে। সে প্রয়োজন উৎসব শেষে ফুরিয়েও যায়। বিসর্জনের সাথে সাথে বিদায় ঘণ্টা বেজে যায় ঢাকিদের। আবার আরেকটা বছরের অপেক্ষা। তবু অনিশ্চয়তা.. কারণ লাইটিং আর সাউন্ডবক্সের জন্যে বাজেট অনেকটা থাকলেও ঢাকের বেলায় আর পয়সা থাকে না।

শিল্পীর সম্মান আমরা দিতে পারি না। আলোর রোশনাইয়ে অস্পষ্ট হতে থাকে ঢাকিদের বায়না। উৎসবের বাইরে র‍্যালি, শোভাযাত্রায় ঢাকের ব্যবহার এখনো ঢিমেতালে টিকে আছে বটে, তবে উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। এসবের বাইরে গিয়ে ঢাকের ব্যবহার এখন পহেলা বৈশাখের শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে এঁকে বছরে একটা দিন সেই জামা গায়ে চাপিয়ে ঘোরবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, পূজার সময় তাঁদের যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাকি সময়টা তাঁরা অবহেলিত থেকে যান। বেশিরভাগ ঢাকি পেশাগতভাবে দরিদ্র পরিবার থেকে আসেন। পূজার বাইরে সারা বছর তাঁদের হাতে কোনো কাজ থাকে না।

আধুনিক সাউন্ড সিস্টেম ঢাকের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে। ফলে তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়েন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক হয়েও অবহেলার শিকার হয়ে আছেন। সমাজে আধুনিকতার ছোয়ায় সব কিছুই এখন ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে। বাদ্য যন্ত্রও এখন ব্যবহৃত হয় ডিজিটালভাবে। মানুষ এখন ঢাক চায়না ঢাকিও চায়না। তাইতো হাতের তৈরি ঢাক-ঢোল, তবলা, খোল ও অন্য বাদ্যযন্ত্রের কদর কমতে শুরু করেছে। এখন যেন মানুষ এসব বাদ্যযন্ত্র শুধু বাসায় সাজিয়ে রাখতেই কিনে নিয়ে যায়।

তবে আশার কথা হচ্ছে বাদ্যযন্ত্র যতই আধুনিক হোক। গুণের বিচারে সবসময় এগিয়ে থাকবে ঢাক-ঢোলের আওয়াজের মধুরতা। কিছু কিছু পার্বন ঢাকের শব্দ ছাড়া চলে না। আধুনিক রুচি এবং ঐতিহ্যে ফিরে আসছে নতুন প্রজন্ম।

রাজবাড়ী ঋষিপাড়ায় একসময় শতশত ঢাক-ঢোলের কারিগর ছিল। বাদ্যযন্ত্র তৈরি, মেরামত ও পূজা পার্বণসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর আয় দিয়ে চলত তাদের সংসার।

মোহন ঢাকি এফটি টীমের এই প্রতিবেদককে বলেন, আগের মত রমরমা আর হাসিখুশির দিন আর নেই। ব্যান্ড বাদক বংশী বাদকদের আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় এ সব লোকজন ছেড়ে দিচ্ছে পূর্বপুরুষের পেশা। বেছে নিচ্ছেন অন্য পেশা। বংশের নতুন কাউকে আর এই পেশায় উৎসাহ দেন না কেউ।

তিনি আরও বলেন, পুজোর এই ক’টা দিন কাঁধে ঢাক নিয়ে মন্ডপে মায়ের আরাধনায় ঢাক বাজিয়ে পুজোর সম্পূর্ণতা ফুটিয়ে তোলা ঢাকিরা পান ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। বাকী সময় চরম আর্থিক অনটনে দিন কাটে তাদের। অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত মানুষদের সরকারী বিভিন্ন বরাদ্দ আসলেও এই বাদ্যকর পেশায় থাকা মানুষ গুলো পায়নি সরকারী কোন সহায়তা। তাই তারা সরকারের কাছে সহযোগীতা পাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।

তার মতে, ক্রমশ কঠিন থেকেই কঠিনতর হয়েই চলেছে এই ঢাকিদের পরিস্থিতি। মাথায় ঋণের বোঝা। এমন অবস্থাতেও এগিয়ে আসেনি কেউ। কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পৌঁছায়নি তাঁদের কাছে। আর সরকারি সাহায্য তো দূরের কথা। সরকারি কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েছেন, পুজো মিটলে সামান্য সাহায্য পাঠাবেন ঢাকিদের। তবে বাকিদের হয়তো সেটাও জোটেনি ভাগ্যে।

ঢাক শুধু বাদ্যযন্ত্র নয়; এটি বাংলার লোকসংস্কৃতির প্রাণ। ঢাকিরা বেঁচে থাকলেই পূজার আবহ সত্যিকার অর্থে পূর্ণতা পায়। তাই ঢাকিদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো তাঁদের শিল্পকে মূল্য দেওয়া, তাঁদের জন্য সারা বছরের জীবিকার ব্যবস্থা করা এবং সমাজে সম্মানজনক মর্যাদা প্রদান করা। না হলে একদিন হয়তো পূজার সময় ঢাকের সেই গম্ভীর ধ্বনি হারিয়ে যাবে—আর হারিয়ে যাবে বাংলার উৎসবের প্রাণ।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.