October 28, 2025, 11:59 pm


আবির আব্দুল্লাহ

Published:
2025-10-28 20:20:26 BdST

ভিসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সার্বিয়া ও উত্তর মেসিডোনিয়াভুয়া ওয়ার্ক পারমিটে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সর্বনাশ


ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহার করে ভিসা আবেদনের ফলে পূর্ব ইউরোপের দুই দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের দেশ সার্বিয়া ও উত্তর মেসিডোনিয়ার ভিসা আবেদনে ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে দেশ দুটির দূতাবাস।

ইতোমধ্যে তারা বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া বন্ধ করেছে। এসব জালিয়াতি না থামালে ভিসা বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে দূতাবাস।

দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্র জানান, উত্তর মেসিডোনিয়ায় দূতাবাসে ভিসার আবেদন করা ৯০ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মীর ওয়ার্ক পারমিট ভুয়া। সার্বিয়ার ক্ষেত্রেও একই চিত্র।

দুই মাস যাবৎ বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কোনো ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করছে না দেশ দুটি। তবু নিয়মিত এসব ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহার করে ভিসার আবেদন আসছে। এভাবে চলতে থাকলে শিগগিরই বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ভিসা বন্ধ করা হবে।

সম্প্রতি উত্তর মেসিডোনিয়াতে বাংলাদেশি পাচারকারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে দেশটির পুলিশ। এর মধ্যে দুজনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও একজনের বাড়ি সিলেটে।

এই চক্রকে আটকের বিষয়টি দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে আলোচনা হয়। সেখানে গ্রেপ্তারকৃত চক্রের সদস্যদের বিচার শেষে জেলে পাঠানো অথবা ডিপোর্ট (নিজ দেশে ফেরত পাঠানো) করার সিদ্ধান্ত হয়।

এদিকে সার্বিয়া ও উত্তর মেসিডোনিয়ার দূতাবাসে ভিসার আবেদনে ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট ব্যবহার করা হচ্ছে। পাশাপাশি সার্বিয়ার নকল স্টিকার ভিসা বানিয়ে প্রতারণা করছে একটি চক্র। এর ফলে একদিকে কর্মীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র, অন্যদিকে হুমকির মুখে পড়ছে বাংলাদেশের শ্রমবাজার।

উল্লেখ্য যে, শ্রমিক ভিসায় কাউকে বিদেশে পাঠাতে হলে ওয়ার্ক পারমিট, ভিসার পাশাপাশি শ্রমশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) স্মার্ট কার্ড প্রয়োজন।

প্রতারক চক্রগুলো সুকৌশলে প্রথমে ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট বানিয়ে ভিসার আবেদন করে। ভিসা আবেদন বাতিল হলে তারা নিজেরাই নকল স্টিকার ভিসা বানিয়ে পাসপোর্টে যুক্ত করে। ভিসার বিপরীতে কর্মীর জন্য নেওয়া হয় বিএমইটি স্মার্ট কার্ড। এরপর বিমানের টিকিট কেটে যাত্রীদের ইউরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে পাঠানো হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে আটকে দেওয়া হয় এসব নকল ভিসাধারীকে।

জানা গেছে, প্রতারক চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বাংলাদেশিদের টার্গেট করে। উন্নত জীবন, মোটা অঙ্কের বেতনের প্রলোভনে তাদের আকৃষ্ট করা হয়।

দি ফিন্যান্স টুডের এক বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে বসবাসরত কয়েকজন বাংলাদেশী নাগরিক সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, আলবেনিয়া ও উত্তর মেসিডোনিয়ায় ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় শ্রমিক নেয়ার নামে বাংলাদেশের তরুন জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণা করছে।ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট, ভুয়া ভিসা ও ভুয়া টিকিট দিয়ে এসব নিরীহ মানুষদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদের পরিবারগুলোকে নিঃস্ব করছে।

এরকমই এক প্রতারণার শিকার মাগুরানিবাসী আবু বকর মুন্সী এই প্রতিবেদককে বলেন, থাইল্যান্ড প্রবাসী মো: ওমর ফারুক গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় আলবেনিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে কয়েকদফায় ৬,৫০,০০০ লক্ষ টাকা নেন। ওমর ফারুকের নির্দেশনা মোতাবেক এই সমুদয় অর্থ উত্তরায় অবস্থিত 'এম/এস সামস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল' এর বিভিন্ন ব্যাংকের একাউন্টে জমা দিয়েছিলাম। উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক একাউন্ট থেকে সমস্ত টাকা তিনি পরে থাইল্যান্ডে নিয়ে যান।

তিনি বলেন, টাকা নেয়ার পর আমাকে ওয়ার্ক পারমিট, ভিসা ও টিকিট দেয়া হয়। পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নির্ধারিত তারিখে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে বুঝতে পারি ওমর ফারুক প্রদত্ত ওয়ার্ক পারমিটটি ভুয়া এবং বিমানের টিকিট জাল। এই বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করলে সে আমাকে বলে যে, এজেন্সি যথাসময়ে টাকা প্রদান করে টিকিট কনফার্ম করতে ব্যর্থ হয়েছিলো তাই টিকিটটি বাতিল হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে আরও দুইদফা আমাকে ভুয়া টিকিট দিয়েছিলো ওমর ফারুক। প্রতিবারই আমি বিমানবন্দরে যেয়ে অপমানিত ও হয়রানির শিকার হই। এরপর থেকে উক্ত ওমর ফারুক আমার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর বুঝতে পারি কত বড় প্রতারণার শিকার হয়েছি আমি।

আক্ষেপ করে আবু বকর মুন্সী বলেন, এনজিও থেকে ঋন নিয়ে ও আত্মীয়দের কাছ ধারদেনা করে এতগুলো টাকা ফারুককে দিয়েছিলাম। এখন আমার পরিবার সামাজিকভাবে প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে। আমি সরকারের কাছে এর সুষ্ঠু তদন্ত পূর্বক ন্যায়বিচার কামনা করছি। বর্তমানে আমার পরিবার প্রতারক ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অপর এক প্রতারণার শিকার মাগুরা নিবাসী ফরহাদ বিশ্বাস এই প্রতিবেদককে বলেন, থাইল্যান্ড প্রবাসী ঐ ওমর ফারুক গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় সার্বিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমার কাছ থেকে কয়েকদফায় ৬,৫০,০০০ লক্ষ টাকা নেন। আমিও ওমর ফারুকের নির্দেশনা মোতাবেক এই সমুদয় অর্থ উত্তরায় অবস্থিত 'এম/এস সামস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল' এর বিভিন্ন ব্যাংকের একাউন্টে জমা দিয়েছিলাম। উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক একাউন্ট থেকে সমস্ত টাকা তিনি পরে থাইল্যান্ডে নিয়ে যান।

টাকা নেয়ার পর আমাকে ওয়ার্ক পারমিটের নামে যে কাগজ দেয়া হয়েছিলো তা যাচাই করে বুঝতে পারি সেটি ভুয়া। পরবর্তীতে নানা টালবাহানা করে দীর্ঘ ১৩ মাস অতিবাহিত হলেও অদ্যাবধি আমাকে আর কোন কাগজপত্রই দেননি ওমর ফারুক। দীর্ঘ অপেক্ষার পর টাকা ফেরত চাইলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ফারুক। বর্তমানে আমি এবং আমার পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছি।

একইভাবে অন্য একটি চক্রের দ্বারা প্রতারণার শিকার মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘গত মে মাসে সার্বিয়ার শ্রমিক ভিসার জন্য অনলাইনে আবেদন করি। দীর্ঘদিন যাবৎ আবেদনটি অপেক্ষমাণ তালিকায় ছিল। তবে সম্প্রতি এজেন্সির কর্মকর্তারা আমার আবেদন আইডির পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে দেন। এর আগ পর্যন্ত আমার আবেদন অপেক্ষমাণ তালিকাতেই ছিল। এখন এজেন্সি থেকে বলছে, এক মাসের মধ্যে অ্যাপ্রুভাল ও স্টিকার ভিসা দেবে। ’

তথ্যমতে এসবই প্রতারণা। ভুয়া ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে আবেদন করার কারণে ভিসা আবেদন অনুমোদন হয়নি। এখন তারা ভুয়া অ্যাপ্রুভাল লেটার ও স্টিকার ভিসা দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নয়াদিল্লির উত্তর মেসিডোনিয়া দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত (বাংলাদেশের অনাবাসি রাষ্ট্রদূত) স্লোবোড্যান উজনভ বলেন, ‘দুই মাস যাবৎ বাংলাদেশিদের জন্য কোনো ওয়ার্ক পারমিট ইস্যু করেনি উত্তর মেসিডোনিয়া। এরপরও কিছু অসাধু চক্র ভুয়া পারমিট ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত ভিসার জন্য আবেদন করছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে শিগগিরই বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দেওয়া হবে। ’

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.