July 7, 2025, 1:33 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-07-06 19:11:05 BdST

সর্বস্তরের মানুষের স্পন্দনে খালেদা জিয়া


বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সর্বস্তরের মানুষের স্পন্দনে জায়গা করে নিয়েছেন। নারী-পুরুষ সকলের মণিকোঠায় ঠাই পেয়ে তিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোন আসনেই হারেননি। আছে বিপুল পরিমাণ ভোটে বিজয়ী হওয়ার রেকর্ড। যা বিগত দিনের সংসদ নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি স্বামী জিয়াউর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত একজন রাজনীতিবিদ। যার তুলনা শুধু তিনি নিজেই।

সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বয়স এখন ৮২ বছর। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলের মামলায় দীর্ঘদিন কারাবরণ করেছেন। শারীরিক অসুস্থতায় রাজনীতির মাঠ থেকে দীর্ঘদিন বাইরে থাকলেও দলের নেতাকর্মীদেরকে সাহস যুগিয়ে চাঙ্গা রাখতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মিথ্যা-বানোয়াট সব মামলা থেকে রেহাই পান বেগম খালেদা জিয়া। এরপর লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান। সেখানে উন্নত চিকিৎসার পর গত কোরবানির ঈদের আগে দেশে ফিরেন তিনি।

দেশে ফিরে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী ওতপ্রোতভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেন। এরইমধ্যে বিভিন্ন সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রেখেছেন। ঈদে নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন। সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির বিদায়ী রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোসটার এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেছেন খালেদা জিয়া। বিশেষ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কোনো বিরোধে না জড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানানোর পর দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছেন জননন্দিত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরপরই বিএনপির রাজনীতিতে যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা।

খালেদা জিয়ার এই আহ্বানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন আপামর জনসাধারণ। এর পরপরই লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা জানান আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এই খবরে সারা দেশে ভোটের হাওয়া শুরু হয়েছে। নেতারা নিজ নিজ আসনে ভোটের বাজার গরম করতে পোস্টার, ফেস্টুন, ব্যানার, মিটিং মিছিল ও ভোটার সহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে যাচ্ছেন। চায়ের স্টলগুলোও বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সাথে কথা বলে যা জানা যায়, তা হলো লন্ডনে বৈঠক, ভোটের পরিবেশ তৈরি এবং রাজনীতিতে একটা স্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে বিএনপির চেয়ারপারসন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যাথাযথ হস্তক্ষেপ ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, খালেদা জিয়া এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বর্তমানে রাজনীতিতে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। শুধু তাই নয়, বেগম জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয়তায় বিএনপি এখন অনেকটাই চাঙ্গা। নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্যতা ফিরে এসেছে।

বিএনপির নেতাদের সাথে আলাপকালে তারা বলছেন, সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির বিদায়ী রাষ্ট্রদূত আখিম ট্রোসটার। এসময় সঙ্গে ছিলেন তার সহধর্মিণীও। গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের বাসভবন ফিরোজায় এই সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় খালেদা জিয়া ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ও চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার। এছাড়া ম্যাডাম বিভিন্ন সমাবেশে ভার্চুয়ালি বক্তব্যও রাখছেন। ঈদে নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও করেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার রাজনীতিতে এমন সক্রিয়তা দলের নেতাকর্মীদের অনেক চাঙ্গা করে তুলেছে। আশা করছি, ম্যাডাম পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে দেশের রাজনীতি ও উন্নয়নে আরও ভূমিকা রাখবেন। তিনি যেভাবে বিএনপির রাজনীতি কন্ট্রোল করেন তা অন্য কারো দ্বারা সম্ভব নয়। তার ধৈর্য, মেধা, প্রজ্ঞার প্রতিফলনে বিএনপির মতো দলে একটুও চিড় ধরেনি। আওয়ামী সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন, হামলা-মামলার শিকার হয়েও নেতাকর্মীরা দলের জন্য কাজ করেছে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ম্যাডাম আগের চেয়ে এখন অনেকটা ভালো আছেন। তবে, এখনও পরিপূর্ণ সুস্থ হননি। তিনি হাসলে বাংলাদেশ হাসে। বিএনপি নেতাকর্মীদের আশার জায়গা ও বাতিঘর হচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া। সম্প্রতি রাজনীতিতে তার সক্রিয়তায় নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে। আমাদের প্রত্যাশা তিনি আরও সক্রিয় হবেন এবং আগের মতো দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। সরাসরি মিটিং এ যোগদান করবেন এটাই সবার প্রত্যাশা।

ওয়াকিবহাল সূত্রমতে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে যখন হত্যা করা হয়, তখন খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহবধূ। দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে তখন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিলেন খালেদা জিয়া। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তখন বিপর্যস্ত ও দিশাহারা। জিয়াউর রহমান এরপর দলের হাল কে ধরবেন, সেটি নিয়ে নানা আলোচনা চলতে থাকে।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যার পর ভাইস-প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয়। তখন আব্দুস সাত্তারের বয়স আনুমানিক ৭৮ বছর। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের বার্ধক্য এবং দল পরিচালনা নিয়ে অসন্তোষের কারণে তৎকালীন বিএনপির একাংশ খালেদা জিয়াকে রাজনীতিতে আনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু রাজনীতির প্রতি খালেদা জিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ ছিলনা। একপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে আসার জন্য দিনের পর দিন খালেদা জিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি দলের হাল না ধরলে দল টিকবে না বলেও অনেকে বলেন। বিএনপির ক্রান্তিলগ্নে দলের হাল ধরেন বেগম খালেদা জিয়া।

দলের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খালেদা জিয়া আত্মপ্রকাশ করেন। সেদিন তিনি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন। একই বছর ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে খালেদা জিয়া প্রথম বক্তব্য রাখেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে খালেদা জিয়া দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হন এবং এপ্রিল মাসের প্রথমে বিএনপির এক বর্ধিতসভায় তিনি ভাষণ দেন। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েকমাস পরেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। এরপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

১৯৮০ দশকে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশজুড়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপক পরিচিত গড়ে উঠে।

৯০'র গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে ১৩৬ টি আসন পেয়ে বিএনপি জয়লাভ করে। রাজনীতিতে আসার ১০ বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে যতগুলো নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তার সবগুলোতেই জয়লাভ করেছেন। ১৯৯৬ সালে আবার বিএনপি ক্ষমতায় আসলে খালেদা জিয়ার দ্বিতীযবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু সেবার আন্দোলনের মুখে বিএনপি বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপির ব্যাপক ভরাডুবি হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি রাজনৈতিকভাবে অনেকটা চাপে পড়ে যায়। খালেদা জিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয়, তার বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হওয়ার কারণে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারেননি। দেশে-বিদেশে সেই নির্বাচন প্রবল বিতর্কের মুখে পড়ে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে বেগম জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে কারাগারের বাইরে ছিলেন। যদিও এজন্য তাকে নানা বিধিনিষেধ পালন করতে হয়। যার মধ্যে ছিল- রাজনীতিতে অংশ না নিতে পারা, কোনো ভাষণ বা বক্তব্য না দেওয়া, বিদেশ যেতে না পারা ইত্যাদি।

এরপর গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক আওয়ামী লীগের পতনের পর মামলা থেকে খালাস পেয়ে লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার জন্য যান। চিকিৎসা শেষে গত কোরবানির ঈদের আগে দেশে ফেরেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরপরই রাজনীতিতে সক্রিয় হতে শুরু করেন তিনি। দলের কান্ডারি দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার হাতকে শক্তিশালী করতে নেতাকর্মীরা বদ্ধপরিকর।

বিএনপি আয়োজিত কনসার্ট জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাঁর গুলশানের বাসভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হোন। তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দ্রুত প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার আহবান জানান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’

দেশনেত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে যেকোনো মূল্যে। বীরের এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যাতে বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে। আসুন, আমরা সবাই মিলে শহীদ জিয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করি। বাস্তবায়ন করি কোটি মানুষের নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন।’

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ১৬ বছর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন, গ্রেপ্তার, হত্যা ও খুনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল আওয়ামী শাসকগোষ্ঠী। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে, সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুন করে বাংলাদেশকে গড়ার। এই আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের জানাচ্ছি আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং আহতদের সমবেদনা। তাঁদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরকাল মনে রাখবে। গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি পরিবারের সম্মানজনক পুনর্বাসন ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হবে।’

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.