November 2, 2025, 2:32 am


সামিউর রহমান লিপু

Published:
2025-11-01 21:31:06 BdST

১৮ হাজার কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করছে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’


আর্থিকভাবে রুগ্ন হয়ে পড়া শরিয়াহভিত্তিক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক পিএলসি’ নামে এই নতুন ব্যাংকটিকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই কার্যক্রম শুরু করানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অনুমোদন পাওয়ার পর এরই মধ্যে নতুন ব্যাংকের সংঘবিধি ও সংঘস্মারক (Articles & Memorandum of Association) ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি নতুন লাইসেন্স ও কোম্পানি নিবন্ধনের জন্যও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে এই একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে পাঁচটি ব্যাংকের বিশাল জনবল। একীভূত হতে যাওয়া এক্সিম, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ইউনিয়ন ব্যাংকে বর্তমানে ১৮ হাজারেরও বেশি কর্মী রয়েছেন, যাদের বেতন-ভাতার পেছনেই বছরে ব্যয় হয় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। সেই সঙ্গে পরিচালন ব্যয়ের জন্য ব্যয় হয় বড় অংকের অর্থ।

এই অবস্থায় নতুন ব্যাংকটি বিশাল কর্মীর চাপ এবং এই বিশাল ব্যয় বহন করে টেকসই হতে পারবে কিনা সে শঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

১৮ হাজার কর্মীর মর্যাদা নিয়ে অনিশ্চয়তা

পাঁচ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সাল শেষে এই ব্যাংকগুলোতে মোট কর্মীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৮১ জন। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ বছরে ব্যয় হয় ১ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।

এই কর্মীরা বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী হিসেবে কাজ করলেও একীভূতকরণের পর তারা একটি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের অংশ হয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে তাদের চাকরির মর্যাদা, বেতন-কাঠামো ও সুবিধাদি অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মীদের মতো হবে কিনা, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়েছে সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, নতুন এই সরকারি ব্যাংকটিকে পাঁচ বছরের মধ্যে আবার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হবে।

সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলেছেন, কর্মীদের এখন সরকারি ব্যাংকের মর্যাদা দেওয়া হলে, ৫ বছর পর পুনরায় বেসরকারীকরণের সময় তাদের মর্যাদা কী হবে, তা নিয়ে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

নতুন ব্যাংকের মূলধন কাঠামো

পরিকল্পনা অনুসারে, ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’-এর অনুমোদিত মূলধন হবে ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

সরকারি মূলধন: সরকার এই ব্যাংকে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন সরবরাহ করবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে নগদে এবং বাকি ১০ হাজার কোটি টাকা সুকুক বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক আমানত: বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা মূলধন আসবে প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের আমানতের বিপরীতে শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে। এটি ‘বেইল-ইন’ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে, যেখানে ব্যাংকের বড় গ্রাহক ও পাওনাদারদের পাওনার একাংশ শেয়ারে রূপান্তরিত হবে।

অগ্রাধিকার পাবেন ক্ষুদ্র আমানতকারীরা

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন ব্যাংক গঠনের পর পাঁচ ব্যাংকের ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বড় আমানতকারীদের অর্থ ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন ব্যাংকটি সরকারি মালিকানাধীন হওয়ায় এখানে মানুষ আমানত রাখতে আগ্রহী হবে এবং লাভজনক খাতে বিনিয়োগ থেকেও ব্যাংকের আয় আসবে, যা ব্যয় নির্বাহে সহায়তা করবে।

বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া

গত সেপ্টেম্বরে এই একীভূতকরণ বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মো. কবির আহাম্মদের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি একীভূতকরণের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে পাঁচ ব্যাংকের ৭৬১টি শাখার অবস্থান এবং প্রয়োজনীয় জনবল কাঠামো নিয়ে কাজ করছে। এরইমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংকে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী—

> এক্সিম ব্যাংক পরিচালনায় থাকবেন নির্বাহী পরিচালক মো. শওকাত উল আলম

> সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দেখভাল করবেন নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মদ বদিউল আলম দিদার

> ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক দায়িত্বে থাকবেন নির্বাহী পরিচালক মো. সালাহ উদ্দীন

> ইউনিয়ন ব্যাংক প্রশাসক হিসেবে থাকবেন পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হাসেম

> গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক তত্ত্বাবধানে থাকবেন পরিচালক মকসুদুল আলম

প্রত্যেক প্রশাসকের সঙ্গে একজন করে অতিরিক্ত পরিচালক, একজন যুগ্ম পরিচালক এবং একজন উপপরিচালক সমন্বয়ে ৫ সদস্যের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসক টিম দায়িত্ব নেবে।

পুরো প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের আইনি জটিলতা যাতে না হয়, সেই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং লিখিত মতামত পাওয়ার পরই প্রশাসক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

অর্থ বিভাগ থেকে মূলধন সরবরাহ চূড়ান্ত হলেই প্রশাসকগন দায়িত্বভার গ্রহন করবেন। তারা দায়িত্ব নেয়ার পর ব্যাংকগুলোর বর্তমান পর্ষদ বিলুপ্ত হবে এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) পদ বাতিল বলে গণ্য হবে।

এই বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, “আমরা নতুন ব্যাংক গঠনের জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছি।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক উভয়ই নিজ নিজ কাজ গুছিয়ে এনেছে। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই একীভূত ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু করা যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে আইনি দিক ও অর্থ ছাড়ের বিষয়টি চূড়ান্ত হলে প্রশাসকরা দায়িত্ব নেবেন।”

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.