March 29, 2024, 3:26 am


বিশেষ প্রতিবেদক

Published:
2022-07-01 07:30:51 BdST

খোশমেজাজে ডিপিডিসি ॥ দায় বুয়েটের ঘাড়ে


বুয়েটের বিআরটিসি ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের অনুমোদিত সিল দেওয়া ডিপিডিসির আলোচিত একটি টেন্ডারকে ঘিরে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সব মানুষ যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি চোখ বন্ধ করে ভরসা করে থাকে সেখান থেকে এমন একটি প্রশ্নবিদ্ধ সার্টিফাই করা প্রসঙ্গ বুয়েটের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞমহল।

মনে করা হচ্ছে বুয়েটের এই বিভাগের কোনো ব্যক্তি ডিপিডিসি’র কোনো সুবিধাবাদী মহলের সাথে একাত্ব হয়ে না বুঝে অথবা কৌশলে কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে এই কাজটি করেছেন। এতে যে সমস্ত দায় বুয়েটের উপর আসবে আর এমন স্বনামধন্য সুশীল প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি খারাপ হতে পারে তা হয়ত তারা বুঝলেও মাথায় নিতে চাননি।

তথ্য মতে, বেশ কিছুদিন আগে ডিপিডিসির নিজস্ব বাজেটের আওতায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার দৈর্ঘের ১১ কেভি ৩-কোর, ৩০০ স্কয়ার মি.মি. ভুগর্ভস্থ এক্সএলপি কপার ক্যাবলস সরবরাহের জন্য টেন্ডার করা হয় যার প্রাক্কলন ব্যয় ছিলো আটান্ন কোটি ছাব্বিশ লক্ষ আশি হাজার টাকা। এস্টিমেট মূল্যের চেয়ে ৯৮% বেশি দামে এসব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সরবরাহ দেয়ার পায়তারা করা হলেও সেটি জানাজানি হয় এবং ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ টেন্ডারটি বাতিল করে পুনরায় দরপত্র আহবান করে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে রি-টেন্ডার সাবমিট হবার পর পর্যালোচনা শেষে তা কার্যাদেশ পর্যায়ে চলে আসলেও ডিপিডিসি পলি ক্যাবলস কোম্পানিকে দরপত্রের শর্তানুযায়ী সিসিভি লাইন নেই মর্মে অভিযোগ ওঠে।

এর ফলে ডিপিডিসি এবং বুয়েটের বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্যদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের ফ্যাক্টরী পরিদর্শন করা হয়। এতে পলি ক্যবলসের টেন্ডারে তথ্য জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত হলে এ বছর সেই দরপত্রটিও বাতিল হয়।

উক্ত ১১ কেভি ৩-কোর আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলস সরবরাহ দেবার জন্য গত ২৭ জুন তারিখে তৃতীয়বারের মত দরপত্র আহবান করা হয়। প্রযুক্তিগত মানের প্রত্যয়নের জন্য ডিপিডিসি থেকে বুয়েটের বিআরটিসি ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং দফতরের পর্যবেক্ষণ ও অনুমোদনের জন্য দেওয়া হলে আগের দেওয়া সিসিভি, সর্বশেষ প্রযুক্তি ভিসিবি’র সাথে এইচসিভি নামক লাইন প্রযুক্তি যুক্ত করে দেওয়া হয়।

১১ কেভি ৩-কোর ৩০০ স্কয়ার মি.মি. ভুগর্ভস্থ এক্সএলপি ইন্সুলেটেড কপার ক্যাবলস এইচসিভি লাইন প্রযুক্তি দিয়ে কিভাবে উৎপাদন সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাবার ইন্সুলেশন বেজড এইচসিভি প্রযুক্তির লাইন দিয়ে (ইলাস্টোমেরটিক রাবার ইন্সুলেটেড ক্যাবলস) সাধারণত ১.৫ আরএম পর্যন্ত লো-ভোল্টেজ ক্যাবলস উৎপদন হয়ে থাকে। এতে নাইট্রোজেন কিউরিং সম্ভব হলেও ৩-কোর এক্সএলপি ১১ কেভি ক্যাবলসের জন্য সিসিভি অথবা ভিসিভি লাইন প্রয়োজন হয়। মনে করা হচ্ছে কোনো একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিকে কাজ পাইয়ে দেবার জন্য এই কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে যাদের এইচসিভি আছে কিন্তু সিসিভি বা ভিসিভি লাইন প্রযুক্তি নেই।

প্রথম এবং দ্বিতীয় টেন্ডারে শুধু সিসিভি লাইনে উৎপাদনের কথা উল্লেখ ছিলো। একই দরপত্র ৩য় বারে এসে এক্সএলপি ক্যাবল উৎপাদনে সিসিভির পরবর্তী এবং সর্বশেষ প্রযুক্তি ভিসিভি’র কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা অবশ্যই সর্বজন সমাদৃত হবার কথা। কিন্তু এইচসিভি লাইনের যে কথা উল্লেখ করা হয়েছে এটা দিয়ে ১১ কেভি মিডিয়াম ভোল্টেজ এক্সএলপি ক্যাবল উৎপাদনের বিষয়টি জোড়াতালি বলে মনে করছেন অভিজ্ঞমহল।

এক্ষেত্রে তিনটি গ্রেডে উৎপাদন খরচ তিন ধরনের। দরপত্রে মূল্যও হওয়া উচিৎ তিন পর্যায়ের। সিসিভির চেয়ে ভিসিভিতে প্রায় ১০% খরচ বেশি হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণভাবে জোড়াতালি দিয়ে এইচসিভিতে এধরনের ক্যাবলস উৎপাদন করা হলে খরচ প্রায় ৪০% কম হতে পারে বলে জানা গেছে। জোড়াতালির এইচসিভি লাইন আছে এমন প্রতিষ্ঠানই দরপত্রে কাজটি পাক এবং এদের জন্যই হয়ত এই কৌশলটি করা হয়েছে বলে মনে করছে অনেকে।

আর এদিকে সবার ইঙ্গিত পলি ক্যাবলস কোম্পানির দিকে। এরা জোড়াতালি দেওয়া প্রযুক্তিকে সিসিভি লাইন আছে উল্লেখ করে দীর্ঘদিন রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানে এধরনের ক্যাবলস সরবরাহ দিয়ে আসছিল। কিছুদিন আগে ডিপিডিসি, বুয়েটের বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্যদের নিয়ে একটি টীম তাদের কারখানা তদন্ত করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে।

প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের রক্ষা করতে এবং নতুন ফর্মূলা বাস্তবায়ন করতে কৌশলে বুয়েটের কাউকে প্রভাবিত করছে বলেও গুঞ্জন উঠেছে।

অন্যদিকে সরকারি দফতরে এ ধরনের ক্যাবলস সরবরাহের দেবার ক্ষেত্রে একই ধরনের বা এর চেয়ে হায়ার গ্রেডের সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহের পূর্বের অভিজ্ঞতার বিষয়টি উল্লেখ থাকে। কিন্তু তৃতীয় দরপত্রে ১১ কেভি ৩ লেয়ার এক্সএলপি ক্যাবলস সরবরাহের জন্য ইলেক্ট্রিক্যাল সরাঞ্জাম কন্ডাক্টরসহ অন্যান্য ইকুইপমেন্ট সরবরাহের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি বুয়েটের সাথে পলি ক্যাবলস কোম্পানি স্পন্সর সংক্রান্ত বিরাট অঙ্কের এমওইউ সাইন করেছে বলেও জানা গেছে। এটা এই কৌশলের অংশ হতে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দুদক সহ অন্যান্য বিভাগকে নজরদারী বাড়াতে অনুরোধ করছেন বিজ্ঞ মহল।

গুঞ্জন উঠেছে, পলি ক্যাবলস কোম্পানি থেকে একটি মহল বিশেষ সুবিধা নিয়ে ডিপিডিসির মত একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এধরনের কর্মকান্ড করছে। তবে বিজ্ঞমহল বলছেন, ডিপিডিসি যদি কোনো নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানকে পছন্দ করে তাদের সরঞ্জাম সরবরাহ নিতে চায় তা নিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ প্রসঙ্গে না এসে কোনো প্রতিষ্ঠান যদি প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা থাকে তবে তাদের সেই প্রযুক্তি সেটআপ করিয়ে সেখান থেকে সেরা মানের ক্যাবলস সরবরাহ নিতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর, আইট্রিপলই’র অন্যতম সদস্য কামরুল হাসানের সাথে মোবাইলে ফোন করে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি বিষয়টি নিয়ে ডিপিডিসির সাথে কথা বলতে বলেন। এরপর বুয়েটের সংশ্লিষ্ঠ বিভাগের দরপত্রে অনুমোদন থাকায় প্রযুক্তিগত দায় বুয়েটের উপর পড়ে এবং এইচসিভি লাইন প্রযুক্তি দিয়ে সাধারণত রাবার ইন্সুলেশনে ১.৫ আরএম পর্যন্ত লো-ভোল্টেজ ক্যাবলস উৎপদন হয়ে থাকে এটি দিয়ে ১১ কেভি ৩-কোর এক্সএলপি ক্যাবল উৎপাদন কিভাবে সম্ভব প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখানে তিনটি অপশন উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।

একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির এটা কৌশল মর্মে অভিযোগ রয়েছে যা বুয়েটের ভাবমূর্তির প্রসঙ্গ, পত্রিকার পরিচয় দিয়ে মতামত জানাতে চাইলে তিনি বলেন, বুয়েট অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য জায়গা যে প্রতিষ্ঠান দুইনম্বরি করেনা। এছাড়া পত্রিকায় আমি এবিষয়ে কোনো কিছু বলতে ইচ্ছুক নই। কিছু জানার থাকলে লিখিতভাবে জানাতে অনুরোধ করেন তিনি।

ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের সাথে মোবাইল ফোনে এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই মূহুর্তে কিছু বলতে পারবো না। বুয়েটের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই বিষয়ে ডিপিডিসির সাথে যোগাযোগ করতে বলেছেন জানালে তিনি প্রক্রিউরমেন্ট বিভাগের সাথে কথা বলতে বলেন।

ডিপিডিসির প্রক্রিউরমেন্ট বিভাগের প্রকৌশলী নোমানের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা খসড়া করে বুয়েটের সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়েছিলো। সেখান থেকে এটি অনুমোদন করে দিয়েছে। এরপর বোর্ড মিটিংয়ে এটা পাশ হয়েছে। কোন গরমিলের বিষয় থাকলে সেটির দায় বুয়েটের।

তিনি বলেন, তিনটি অপশন দেওয়া হয়েছে যার যে প্রযুক্তি আছে তারা সেটা নিয়েই দরপত্রে অংশগ্রহণ করবে। তিন প্রযুক্তির খরচ তিন রকম এছাড়া আপগ্রেট প্রযুক্তিকে প্রাধান্য না দেওয়ার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এরবেশি কিছু বলতে ইচ্ছুক নই।

এ বিষয়ে উপসচিব ও ডিপিডিসির কোম্পানি সচিব মোঃ আসাদুজ্জামানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, এই দরপত্রের এসব বিষয়ে প্রকিউরমেন্ট বিভাগ থেকে বুয়েটের কাছে কোয়ালিটি অনুমোদন চেয়ে পাবার পর বোর্ড মিটিংয়ের মাধ্যমে সেটি পাশ হয়েছে আমি এটুকুই জানি। এখানে অন্য কোনো বিষয় থাকলে তা আমার জানার কথা নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে আমরা সব সময় নিয়মের মধ্যে থেকেই কোয়ালিটি যাতে নিশ্চিত হয় সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকি।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা