সজিব তুষার
Published:2024-10-08 12:26:52 BdST
মানবকল্যাণে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম
জনকল্যাণমূখী সংস্থা ইসলামী মানবতাবাদী ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। মুসলমানের বেওয়রিশ লাশ দাফনের উদ্দেশ্যে সংস্থাটির গঠন করা হলেও আটকে থাকেনি ধর্মীয় ধরাবাঁধায়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের পাশেই থাকতে চায় আঞ্জুমান। শুধু একটা ফোন কলেই লাশের পাশে পৌছে যায় আঞ্জুমানের লাশবাহী গাড়ী। অসহায় ও দুস্থ রোগীদের বিপদে এগিয়ে যেতে ৪০টিরও বেশি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে তাদের।
লাশ দাফন ছাড়াও লাশ বহনে ফ্রি-অ্যাম্বুলেন্স ও ফ্রিজিংভ্যান সেবা, এতিমখানা, অবৈতনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান, নারীদের আত্মনির্ভর করে তুলতে নিজস্ব উদ্যোগে সেলাই প্রশিক্ষণ এবং সেলাইমেশিন প্রদানসহ অগণিত কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছে এ সংস্থাটি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব এম এ খালেক ও পরিবারবর্গের আঞ্জুমানের কাকরাইল কার্যালয়ে দানকৃত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্স। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের যেকোনও সেবাকেন্দ্রে কল করলেই পৌছে যাবে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ।
কলকাতায় এ বিপ্লবের শিক্ষা ও সমাজ-সংস্কৃতি ভিত্তিক সূচনা হয় আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে ছাড়াও সংস্থাটির পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল মৌলভী মোহাম্মদ ইসা খান, মৌলভী মোহাম্মদ হেদায়েত হোসেন, মুনসী চৌধুরী আমানুল্লাহ, মুনসী হাফিজ নাজির আহমদ সাহেব, মুনসী বদরুজ্জামান বদর, মুনসীন ওয়াজীশ আলী, মুনসী আব্দুল মোকারেম ফজলুল ওহাব, মুনসী কোরবান আলী, মৌলভী আব্দুল কাভী, মৌলভী সৈয়দ মকবুল আহমেদ প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিদের।
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরপরই প্রথম আহবায়ক এ এফ এম আবদুল হক ফরিদীর (এডিপি, ইস্টবেঙ্গল) হাত ধরে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি গঠিত হয় ঢাকায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবিবুল্লাহ বাহার সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন।
'৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে নতুন উদ্যমে কার্যক্রম শুরু করে আঞ্জুমান। সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুন মাসে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে এখন পর্যন্ত দায়িত্বরত আছেন প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব, রাষ্ট্রদূত (অব.) মুফলেহ আর ওসমানী।
১৯০৫ সালের বেওয়ারিশ লাশ দাফন থেকে কার্যক্রম শুরু করলেও ধীরে ধীরে নিজেদের পরিসর বাড়াতে থাকে আঞ্জুমান। লাশ বহনে ফ্রি-অ্যাম্বুলেন্স ও ফ্রিজিংভ্যান সেবা, এতিমখানা, অবৈতনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রদান, নারীদের আত্মনির্ভর করে তুলতে নিজস্ব উদ্যোগে সেলাই প্রশিক্ষণ- সেলাই মেশিন প্রদানসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে জনকল্যানে নিয়োজিত এ সংস্থাটি।
লাশ গোসল করানো হচ্ছে আঞ্জুমানের নিজস্ব সেবাকেন্দ্রে । ছবি: আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম
একশ বছরের বেশি সময় ধরে হাসপাতালের মর্গে স্বজনহারা বেওয়ারিশ লাশ বিনামূল্যে দাফনের মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে আঞ্জুমান।
সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে ৫০৫৬টি লাশ পরিবহন করেছে তারা। এই সময়ে দাফন করা হয়েছে ১২ হাজার ৯ শত আটটি বেওয়ারিশ লাশ। এর সঙ্গে ৫১২০টি ওয়ারিশ লাশ ও দাফন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম।
করোনাকালীন এ মহাসংকটের সময়েও দমে থাকেনি আঞ্জুমান। ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে আত্মীয় স্বজনেরা যখন লাশ দাফনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে, এইসব লাশেদের মহাজাগতিক ঠিকানায় হস্তান্তর করে আঞ্জুমান। করোনাক্রান্ত রোগীদের লাশ দাফনের গুরুদায়িত্বপালন করে তারা।
লাশ পরিবহন, দাফন, দুস্থ ও অসহায় মানুষদের চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি বিশ্ব ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের মধ্যে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিবছর গঠন করা হয় অস্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প। অসহায় ও বিধবা মহিলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও সাহায্যেও কাজ করছে তারা। গরীব ও বয়স্কদের ভাতা প্রদানের পাশাপাশি অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতার ব্যবস্থাও করে থাকে সংস্থাটি। এছাড়াও সহায়-সম্বলহীন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ, দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায় চিকিৎসা সেবা ও ত্রাণ সহায়তাও প্রদান করে মানবতাবাদী এ সংস্থাটি।
এছাড়া ঢাকা মহানগরীতে গরীব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে প্রদান করে অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। ৪০টি অ্যাম্বুলেন্স ও ফ্রিজিংভ্যানের মাধ্যমে লাশ ও রোগী পরিবহন করা হয় বিনামূল্যে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষা সেবায় এগিয়ে যাচ্ছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। বিশেষ করে অসহায়, এতিম ও দরিদ্রদের শিক্ষায় হাত বাড়িয়েছে তারা। ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে এ সংস্থাটির রয়েছে ৯টি এতিমখানা। আঞ্জুমান জামিলুর রহমান ইসলামিয়া জুনিয়র হাইস্কুল এবং আঞ্জুমান রায়হানা মাহবুব নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে সংস্থাটি।
রাজধানীর গেন্ডারিয়ার এস কে দাস রোডে অবস্থিত আঞ্জুমান এ বি এম জি কিবরিয়া বালিকা হোম। সেবাকেন্দ্রটি ২৯ জন বালিকা নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয় । অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম টেকনিক্যাল ইন্সিটিটিউট ও আঞ্জুমান রায়হানা মাহবুব টেকনিক্যাল ইন্সিটিটিউট নামে দুটি কারিগরি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন তারা। এছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে রাজধানীর শ্যামলীতে একটি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট স্থাপন করেছে জনকল্যানমূখী এ সংস্থাটি।
মানবসম্পদ উন্নয়নে অক্লান্তভাবে কাজ করে যাচ্ছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় গড়ে তুলতে টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের আওতায় বিভিন্ন এলাকায় প্রশিক্ষণ কর্মসুচি গ্রহণ করা হচ্ছে। নারীদের আত্মর্নির্ভশীল করে তুলতে সেলাই প্রশিক্ষণ ও নারী উদ্যোক্তা তৈরীতে প্রদান করা হচ্ছে সেলাই মেশিনসহ নানাবিধ সহায়তা।
শতভাগ পাশের সাফল্য নিয়ে কারিগরি শিক্ষার প্রসারে বিনামূল্যে সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৪ সালে গেন্ডারিয়া থেকে এর যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে রাজধানীর গোপীবাগে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। স্কুল ভবন নির্মাণের জন্য জমিটি দান করেছেন মরহুম রিদওয়ান রহমানের মা ও আঞ্জুমানের বর্তমান কমিটির সদস্য ডা. লুৎফুন নাহার। প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন মির্জা আবদুল হাই।
গেন্ডারিয়ার ৪৪, রজনী চৌধুরী রোডে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২০ জন বালক নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয়। একশর অধিক আসনসংখ্যা বিশিষ্ট হোমে বর্তমানে আছে ৭-১৯ বছর বয়সী ৬৫ জন বালক। হোমে পড়াশোনা করানোর জন্য রয়েছেন ৯ জন অভিজ্ঞ খণ্ডকালীন হোম টিউটর। আর সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য হোম সুপার রইসুল ইসলামের নেতৃত্বে রয়েছে ৯ জন কর্মচারী। হোমে সরকারি ‘ফুড পিরামিড’ মাফিক তিন বেলা খাবার, নাস্তা ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা রয়েছে। স্বাস্থ সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে আছে খেলাধুলার জন্য মাঠ, ইনডোর গেইমে কেরাম, টেবিল টেনিস, দাবা, লুডো ইত্যাদি। এছাড়াও বাচ্চাদের চিকিৎসা, প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, উৎসবে নতুন পোষাক, বিশেষ খাবার প্রদানসহ সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ানুষ্ঠানের মত নানান সৃজনশীল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এই হোম থেকে পড়াশোনা করে অনেকে এখন ভালো ভালো অবস্থানে আছেন। নাজমুল হাসান নামের এই হোমের একজন শিক্ষার্থী বর্তমানে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অধ্য়য়নরত।
গেন্ডারিয়ার ৫, এস কে দাস রোডে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ২৯ জন বালিকা নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয়। শতাধিক আসন বিশিষ্ট এ হোমে বর্তমানে আছে ৭ থেকে ১৯ বছর বয়সী ১৩০ জন বালিকা। এখানে পড়াশোনা করানোর জন্য রয়েছেন ১০ জন অভিজ্ঞ খন্ডকালীন হোম টিউটর। আর সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য হোম সুপার নুসরাত জাহানের নেতৃত্বে রয়েছে ৯ জন কর্মচারী।
“রানা প্লাজায় আহত নিহতদের অনেকের সন্তানই এখানে আছে।” সোনিয়া বলেন, “আমার আম্মুকে তিনদিন পর পাওয়া যায়। তারপরেই আমার আঞ্জুমানে আসা।”
মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের যাকাত, ফেতরা, সাদকা নিয়েই চলা শুরু মানবকল্যানমূখী এ সংস্থাটির। পাশাপাশি নিজস্ব ট্রাস্টের ফান্ড, দান ইত্যাদির মাধ্যমেও আসে অর্থ। এছাড়াও আঞ্জুমানের নিজস্ব ভবন, বাড়ি, ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানসহ রয়েছে প্রচুর সম্পত্তি, যেগুলো মানবকল্যাণের স্বার্থে কারও না কারও দানকৃত সম্পদ।
“আঞ্জুমান যে টাকাটা খরচ করে সেটা সম্পূর্ণ দেশীয়। আমাদের এমনও ডোনার আছে যে দশ টাকা দেয়। একজন দাতাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আপনিতো নিজেই ভিক্ষা করেন। আপনি দশ টাকা কেন দিয়ে গেলেন? উনি বলেছিলেন, আমি মরে গেলে আপনারাইতো আমাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। অতএব আমার এখানে কিছু দেওয়া উচিৎ।”
রাজধানীর গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডে আঞ্জুমান শেঠ ইব্রাহিম মোহাম্মদ ডুপ্লে বালক হোম। সেবাকেন্দ্রটি ২০ জন বালক নিয়ে ১৯৬০ সালে স্থাপিত হয় ।
আঞ্জুমান জেআর টাওয়ারের নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন। স্থাপনাটির কাজ সম্পন্ন হলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কার্যালয়গুলোকে একত্রে আনা হবে। এছাড়া টাওয়ারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হবে। যার সম্পূর্ণ অর্থ আঞ্জুমানের জনকল্যাণমুখী কাজেই ব্যয় করা হবে।
‘আঞ্জুমান টাওয়ার’ তৈরি সম্পন্ন হলে অনেক কাজ হাতে আছে তাঁদের। টাওয়ারটা হয়ে গেলে সবকিছুকে একত্রে নিয়ে আসা যাবে। কাজের আরও অগ্রগতি হবে।
নিজস্ব কাজের গতি ও মানবাধিকার রক্ষায় নিয়োজিত থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুখ্যাতি অর্জন করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। ১৯৯৪ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরষ্কার, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা দিবস জাতীয় পুরষ্কারসহ সংস্থাটি অর্জন করেছে একাধিক পুরষ্কার। এছাড়া আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হিলটন হিউম্যানিটেরিয়ান প্রাইজ এর জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পায় আঞ্জুমান।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.