May 21, 2025, 6:21 am


কূটনৈতিক প্রতিবেদক

Published:
2025-05-21 01:46:05 BdST

কে হচ্ছেন নতুন পররাষ্ট্র সচিব


মাত্র আট মাস পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করা মো. জসীম উদ্দিনকে লম্বা ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তার জায়গায় ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মো. নজরুল ইসলাম।

এদিকে নতুন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসাদ আলম সিয়ামকে বিবেচনা করছে সরকার। তবে বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হওয়ার কারণে পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণে কিছুটা বিলম্ব হবে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘নতুন পররাষ্ট্র সচিব কে হবেন— এই সংক্রান্ত একটি সামারি প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বুধবার (২১ মে) ফেরত এসেছে। ওই সামারিতে পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে তিনজনের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং এদের মধ্যে আসাদ আলম সিয়ামের নামটি বিবেচিত হয়েছে।’

আসাদ আলম সিয়াম

১৯৮৭ সালে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের পরে বুয়েটে আর্কিটেকচার বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৫তম ব্যাচে বিসিএস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করার পর সিয়াম ১৯৯৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন।

প্রথম বিদেশ পোস্টিং ছিল ইন্দোনেশিয়া এবং এরপর ব্যাংকক। ঢাকায় ফিরে এসে ফরেন সেক্রেটারি অফিসের ডাইরেক্টর হিসাবে কাজ করেন। ২০০৭-০৮ সালে ইফতেখার আহমেদ চৌধুরির পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অফিসের ডাইরেক্টর হিসাবেও কাজ করেছিলেন তিনি।

প্রথম পোস্টিং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হলেও পরের দুটি পোস্টিং ছিল ইউরোপে। প্রথম ম্যানচেস্টার মিশন এবং পরে মিলানে মিশন প্রধান হিসাবে কাজ করেন। এরপর ঢাকায় ফিরে এসে ইউরোপ অনুবিভাগের মহাপরিচালক এবং পরে চীফ অফ প্রটোকল হিসাবে কাজ করেন।

রাষ্ট্রদূত হিসাবে প্রথমে ম্যনিলায় কাজ করার পরে ফিরে আসেন মন্ত্রণালয়ে। ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ মিশন হিসাবে কাজ করার পরে অস্ট্রিয়াতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সিয়ামকে। গত বছর আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূত হিসাবে পাঠানো হয় তাকে।

বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রথমে সুপিরিয়র সিলেকশনে বোর্ডে তাকে সচিব পদমর্যাদা দেওয়া হবে। এরপর তিনি পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এজন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

কেন ছুটিতে যাচ্ছেন পররাষ্ট্র সচিব

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন মো. জসীম উদ্দিন। পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রধান উপদেষ্টার দফতর খুশি থাকলেও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে দূরত্ব তৈরি হয়।

গত এপ্রিলে রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমানকে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগকে কেন্দ্র করে এই দূরত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। সর্বশেষ মে মাসে জাপানের সঙ্গে ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) স্থগিত করার জন্য পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের সিদ্ধান্তে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে প্রধান উপদেষ্টার দফতর।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিনের বিদায়ের পর পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে, তা নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের মধ্যে চলছে মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ। কারণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ ও বদলির বিষয়ে চার উপদেষ্টাকে নিয়ে যে কমিটি গঠিত হয়েছে, তাদের মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিনকে রাখা না রাখা নিয়ে  বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠে।

চার উপদেষ্টার এই কমিটিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গাবিষয়ক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান। তার সঙ্গে আছেন কমিটির অন্য দুই সদস্য- তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।

এখন কোন পক্ষের লোক পররাষ্ট্রসচিবের পদ পাবেন, তা নিয়ে চলছে চাপা উত্তেজনা। ১৭তম ব্যাচের পেশাদার কূটনীতিক বর্তমান পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিন ছিলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের পছন্দের ব্যক্তি। কিন্তু জসিম উদ্দিনের ব্যাপারে বেশ কিছু অভিযোগ তুলে গত দুই সপ্তাহ আগেই তাকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ড. খলিলুর রহমান এবং অন্য দুই উপদেষ্টা আদিলুর রহমান ও মাহফুজ আলম।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ইস্যুতে ড. খলিলুর রহমান ও তৌহিদ হোসেনের সিদ্ধান্তে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন, মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর দেওয়ার বিষয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের জানান, এই বিষয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার এই বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সুশীল সমাজ, সামাজিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

কয়েক দিন পর একটি সেমিনারে ড. খলিলুর রহমান বিষয়টি খোলসা করে জানান যে, মানবিক করিডর নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এছাড়া সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদায় সাবেক রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমানের নিয়োগ নিয়ে ড. খলিলুর রহমান ও তৌহিদ হোসেনের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এই নিয়োগের পক্ষে ড. খলিলুর রহমানের সায় থাকলেও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিনের অনাগ্রহে সুফিউর রহমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বসতে পারেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। 

পররাষ্ট্রসচিব পদে নিয়োগ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষ্যের মধ্যে বিরোধের জেরে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলছে অচলাবস্থা। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগের ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে জটিলতা। সব মিলিয়ে মারাত্মক অস্বস্তি বিরাজ করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে।

অব্যাহতিপত্র না পাওয়া পর্যন্ত পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিনকে অফিস করতে বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। গতকাল পর্যন্ত তিনি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন ফাইলে সই করেন। এর বাইরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মৌখিক নির্দেশনায় গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) মো. নজরুল ইসলামও। তবে পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে জসিম উদ্দিনের টিকে যাওয়ার চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে বলে আরেকটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। 

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.