December 6, 2025, 1:05 am


শাহীন আবদুল বারী

Published:
2025-12-06 00:18:29 BdST

টাঙ্গাইলে সুজনের জেলা কমিটির শীর্ষপদে চিহ্নিত আওয়ামী দোসর


লাল বৃত্তের ব্যক্তিই হচ্ছেন সুজনের নবগঠিত টাঙ্গাইল জেলা কমিটির সহসভাপতি হারুন-অর রশীদ

দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন নাগরিক সংগঠন 'সুশাসনের জন্য নাগরিক' - সুজনের নবগঠিত টাঙ্গাইল জেলা কমিটির সহসভাপতি সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে চিহ্নিত আওয়ামী দোসর ও সুবিধাভোগীরা স্থান পেয়েছে। ফ্যাসিষ্টের এসব দোসররা গত ১৫ বছর বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঠনের শীর্ষ পদ দখল করে রেখেছিলো। আওয়ামী লীগের দালালী করে অনেকে আবার কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তুলেছেন। ৫ আগষ্টের পর অনেকটা আত্মগোপনে থাকা চরম বিতর্কিত এসব ব্যক্তিরা সুজনের পদ পেয়ে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

সুজনের মতো একটি অরাজনৈতিক সংগঠন কিভাবে বিতর্কিত আওয়ামী দোসরদের যাচাই-বাছাই ছাড়াই সদস্য করেছে তা নিয়ে সর্বমহলে আলোচনা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই কমিটি টাঙ্গাইল জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন সুজন এর ঊর্ধ্বতন একজন কর্তাব্যক্তি।

জানা গেছে, অতি সম্প্রতি সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের টাঙ্গাইল জেলা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নিয়েছেন ফ্যাসিষ্ট হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরে সুবিধাভোগী চিহ্নিত আওয়ামী দোসর হারুন-অর রশীদ। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেছে চিহ্নিত আওয়ামী লীগের দোসররা।

শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রশাসনের দালালী, চাটুকারীতা, এনজিও’র নামে সাধারন মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মাসাৎ এবং অবৈধ উপায়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন হারুন অর রশীদ। টাঙ্গাইলে আত্মস্বীকৃত বাজে প্রকৃতির মানুষ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। এমন একজন ব্যক্তি সুজনের মত একটি দেশসেরা নাগরিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কিভাবে আসীন হলেন --- এনিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা।

এদিকে সুজনের টাঙ্গাইল জেলা কমিটির সভাপতি খান মোহাম্মদ খালেদ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দেশের বাইরে অবস্থান করার সুযোগে হারুন অর রশীদ আগামী ৬ ডিসেম্বর গোলটেবিল আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন। এনিয়ে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের মাঝে। তার মতো একজন চিহ্নিত আওয়ামী দোসরের সভাপতিত্বে সুজনের গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেনা হাসিনা সরকারের গত ১৫ বছরে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।

সম্প্রতি সরেজমিনে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টাঙ্গাইলের শীর্ষ গডফাদার প্রয়াত ফজলূর রহমান খান ফারুকের ডানহাত ছিলেন হারুন অর রশীদ। টাঙ্গাইলে তিনি প্রশাসনের একজন চাটুকার ও আওয়ামী লীগের চিহ্নিত দালাল হিসেবে পরিচিত। ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হারুন গত ১৫ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন।

টাঙ্গাইলের প্রায় দেড়শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহি টাঙ্গাইল ক্লাবের সাধারন সম্পাদকের পদ দখলসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের শীর্ষ পদ দখলে রাখেন হারুন অর রশীদ। ৫ আগষ্টের পর নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে হারুনকে টাঙ্গাইল ক্লাবের সাধারন সম্পাদকের পদ থেকে বিতাড়িত করে সাধারন সদস্যরা। তার স্ত্রীকে অধ্যক্ষের পদে বসিয়ে দখলে রাখেন টাঙ্গাইল প্রি-ক্যাডেট স্কুলটি। এই স্কুলের মার্কেট নির্মানের দায়িত্ব পেয়ে হারুন তার পরিবারের সদস্যদের নামে ছয়টি দোকান দখল করেন নামমাত্র মুল্যে। এসব দোকানের বর্তমান মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা।

হারুনের স্ত্রীর বিরুদ্ধেও রয়েছে স্কুলের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। গত ৫ আগষ্ট হাসিনার পতন হলে স্কুলের অভিভাবক ও শিক্ষকরা অধ্যক্ষের পদ থেকে হারুনের স্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করে। সাধারন মানুষ ও অভিবাবকদের রোষানল থেকে হারুন ও তার স্ত্রীকে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সেসময় রক্ষা করে নিরাপদে সরিয়ে নেয়।

টাঙ্গাইল ক্লাবের সাধারন সদস্যদের অভিযোগ, শেখ হাসিনার আমলে ক্লাবের গঠনতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহের এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছানোয়ার হোসেন এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সোহেল হাজারী এমপি, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র সিরাজুল হক আলমগীর, শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গোলাম কিবরিয়া বড় মনি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলে খান আহমেদ শুভ এমপি ও আওয়ামী লীগের আরেক সেনাপতি ও দোসর প্রেসক্লাবের সভাপতি জাফর আহমেদসহ অন্তত ১৫ জনকে সদস্যপদ দেন হারুন অর রশীদ। ক্লাবের গঠনতন্ত্রে পিতা-পুত্রের সদস্য পদ লাভের কোন বিধান ছিলো না। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তার ছেলেকে সদস্যপদ দেয়ার জন্য গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করেন তিনি। ফলে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক টাঙ্গাইল ক্লাবকে কার্যতঃ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে পরিনত করা হয়। আর এই ক্লাব থেকেই ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগের সকল অপকর্ম পরিচালিত হয় গত প্রায় ১৫ বছর।

টাঙ্গাইল ক্লাবের সাধারন সম্পাদক হারুন অর রশীদ নিজ উদ্যোগে প্রতিবছরই শেখ হাসিনাসহ শেখ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্মদিন পালনের প্রথা চালু করেন জাকজমকভাবে। জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাধারন সম্পাদক, সাবেক মন্ত্রী ও টাঙ্গাইল ক্লাবের সদস্য এডভোকেট আব্দুল সালাম পিন্টুকে ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার মিথ্যা মামলায় আসামী করা হলে ক্লাবের সদস্যপদ বাতিল করে অনার বোর্ড থেকে সালাম পিন্টুর নাম মুছে ফেলা হয়। প্রায় ১৭ বছর কারাবরন শেষে ৫ আগষ্টের পর আব্দুস সালাম পিন্টু মুক্তি পেলে রাতের অন্ধকারে ক্লাবের অনার বোর্ডে পুনরায় তার নাম লিখে দেন হারুন অর রশীদ।

সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৭-১৯৯৮ সালের দিকে জিডিএস নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠা করে নির্বাহী পরিচালকের পদ নেন হারুন অর রশীদ। উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে সাধারন মানুষের কাছ থেকে ডিপোজিটের নামে কয়েক কোটি টাকা সঞ্চয় করা হয়। এরপর হঠাৎ বিনা নোটিশে বন্ধ করে দেন এনজিওটি। কিন্তু একযুগ কেটে গেলেও গ্রাহকরা তাদের সঞ্চিত অর্থ ফেরত পায়নি। এভাবে প্রতারনার মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন হারুন।

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির আশির্বাদপুষ্ট হারুন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি, সৌখিন মৎস্য শিকারী সমিতির সহসভাপতি, এসপি পার্কের সহসভাপতি, ডিসি পার্কের সহসভাপতিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের শীর্ষপদ গুলো দখলে রাখেন।

চিহ্নিত এমন একজন দুর্নীতিবাজ ও আওয়ামী দোসর হারুন অর রশীদ 'সুশাসনের জন্য নাগরিক' এর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সংগঠনের শীর্ষপদে কিভাবে আসীন হলেন- এমন প্রশ্নের কোন উত্তর মিলছেনা।

এমতাবস্থায়, এই বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না টাঙ্গাইলের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ সচেতন মহলের লোকজন। এতে সুজনের ভাবমুর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.