May 14, 2024, 6:29 am


Abu Taher Bappa

Published:
2019-11-28 23:43:51 BdST

বেড়েই চলেছে আর্থিক খাতের ‘বিষফোড়া’খ্যাত খেলাপি ঋণ


সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা তৎপরতার পরও কমছে না খেলাপি ঋণ। উল্টো বেড়েই চলেছে আর্থিক খাতের ‘বিষফোড়া’খ্যাত খেলাপি ঋণের পরিমাণ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর- এই তিন মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ফলে এই মুহূর্তে এর পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।

৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। তবে প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে আইএমএফের হিসাবে ব্যাংকিং খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ অবলোপন করা হয়েছে ৪০ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এর সঙ্গে সাড়ে ছয় বছরের ১ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ কোটি ও ঋণ পুনর্গঠনের ১৫ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। যেগুলো খেলাপির পর্যায়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আরও জানা যায়, আন্তর্জাতিকভাবে ২ থেকে ৩ শতাংশ খেলাপি ঋণকে সহনীয় বলে ধরে নেয়া হয়। এর বেশি থাকলেই তা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়। আর খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশ হলে সেটি হচ্ছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সে হিসাবে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ১২ শতাংশ। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে করেই হোক খেলাপি ঋণের আদায় বাড়াতে হবে। নতুন করে যাতে আর কোনো ঋণ খেলাপি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ প্যাকেজ দিয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর চেষ্টা করা হলে তা ব্যাপক অর্থে কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তিন মাস আগে (জুন শেষে) মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।

সর্বশেষ ১৭ নভেম্বর মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ পুনঃতফসিলের (রিশিডিউলিং) সুবিধার সময়সীমা বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আরও ৯০ দিন সময় পাবেন আবেদনকারীরা। সূত্রমতে, এই সুবিধায় ঋণ পুনঃতফসিল করে ইতিমধ্যে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হয়েছে। তারপরও খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়নি।

খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বাড়তি মূলধন রাখত হচ্ছে, অন্যদিকে খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হচ্ছে প্রভিশন। এতে ব্যাংকগুলোর অর্থ আটকে থাকছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।

উল্লেখ্য, ১০ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সব ব্যাংকের এমডি ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না।’ তার এই ঘোষণার পর জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রথমবারের মতো ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ সময় খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায় ১৬ হাজার ৯৬২ কোটি টাকা।

পরবর্তী তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল-জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা এবং সর্বশেষ জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। মন্ত্রীর ঘোষণার পরও সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৯৩ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ ৯৯ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা।

খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নানা ধরনের নীতিগত সুবিধা দেয়া হলেও বাস্তবে তা কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, যে জিনিসকে উৎসাহ দেয়া হয়, সেটা বাড়ে আর নিরুৎসাহিত করলে কমে। এখানে খেলাপিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে, তাই সেটা বাড়ছে। আর ভালো গ্রাহকদের নিরুৎসাহিত করার কারণে তাদের সংখ্যা কমছে। এটা পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে আরও দেখা যায়, তিন মাসের ব্যবধানে বেসরকারি ৪০ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা বেড়েছে। সেপ্টেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৫৪৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক শূন্য ৪৩ শতাংশ। গত জুন শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। একইভাবে সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪ হাজার ৯২২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩১ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এর আগের প্রান্তিকে এসব ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ছিল ৫৩ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সে হিসাবে গত তিন মাসে সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯১ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ১ শতাংশ। গত জুন শেষে এসব ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২ হাজার ৫৭ কোটি ৬২ টাকা, যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে দুই বিশেষায়িত ব্যাংকের (কৃষি ও রাকাব) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা গত জুন শেষে ছিল ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। ব্যাংক দুটির বিতরণ করা ঋণের ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ খেলাপি।

এদিকে বুধবার রাজধানীর হোটেল লা মেরিডিয়ানে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হক সিদ্দিকী বলেন, যেসব ব্যাংকে কর্পোরেট গভর্নেন্স ভালো, তাদের খেলাপি ঋণ কম এবং যাদের কর্পোরেট গভর্নেন্স খারাপ, তাদের খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। এছাড়া একটি ব্যাংকে পরপর তিনটি কোম্পানি অডিট করার পরও কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায় না। অপরদিকে দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। এ কারণে মন্দ ঋণ কমাতে হলে পরিচালনা পর্ষদ, ইন্টার্নাল ক্রেডিট রেটিং বিভাগ, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসহ সবার সামষ্টিক প্রচেষ্টা দরকার।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আশি ও নব্বইয়ের দশকে হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি এবং গ্রাহকের সংখ্যা কম। একই গ্রাহকের ওপর একাধিক ব্যাংক নির্ভরশীল। খেলাপি বৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি। এছাড়া বর্তমানে ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এদের দমন করতে হলে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ খুবই জরুরি। খেলাপি ঋণ কমাতে যেসব আইন রয়েছে, সেগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে, সেটাও দেখার বিষয়।

Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.


Popular Article from FT বাংলা