বিশেষ প্রতিবেদক
Published:2024-11-06 23:42:41 BdST
বেঙ্গল গ্রুপের মালিক মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগন্যাশনাল লাইফের সাড়ে চারশ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেখ হাসিনার দীর্ঘ ফ্যাসিজমকে টিকিয়ে রাখতে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করেন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়ে তারা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়েছেন। তার ত্রাণ তহবিলে শত শত কোটি টাকা ‘দান’ করে ‘ভালো মানুষী’ কুড়িয়েছেন। বিপরীতে এসব ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ বিক্রি করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকায়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের বরাত দিয়ে ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে লুটে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। এমনই একজন হচ্ছেন বেঙ্গল গ্রুপের মালিক মোরশেদ আলম।
ব্যবসায়ী থেকে শেখ হাসিনার কল্যাণে ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে যাওয়া মোরশেদ আলম নোয়াখালি-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন তিন বার। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনেও তিনি এমপি হন। তবে এর আগে তিনি শেখ হাসিনার ত্রান ফান্ডে দান করেন এক শ’ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগের ডোনার মোরশেদ আলম ছোট ভাই মোহাম্মদ জসিমউদ্দিনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বসান এফবিসিসিআই’র প্রেসিডেন্ট পদে। এভাবে তিনি ব্যবসায়ী কমিউনিটিতে প্রতিষ্ঠা করেন আধিপত্য।
বেঙ্গল গ্রুপের মালিক মোরশেদ আলমের বিরুদ্ধে রয়েছে টেলিভিশন দখল, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি দখল, জায়গা-জমি দখল, বেনামী প্রতিষ্ঠান খুলে সেটিকে ‘শতভাগ বিদেশী বিনিয়োগ’ দেখিয়ে নানামাত্রিক সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ, আমদানি-রফতানির নামে অর্থ পাচার, শূল্ক ছাড়ের সুবিধা নিয়ে প্লাস্টিক দানা (রেজিন) আমদানি করে চোরাই বাজারে বিক্রি, জাল-জালিয়াতি, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে টানা ১১ বছর কব্জায় রেখে ইচ্ছে মতো লুটপাট, প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সদস্যদের কোনঠাঁসা করতে দুদককে দিযে মামলা দায়ের, পর্যাপ্ত শেয়ার থাকা সত্ত্বেও পরিচালকদের বোর্ডে ঢুকতে না দেয়া, একই সঙ্গে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও চেয়ারম্যান পদ কব্জায় রাখাসহ বহুমাত্রিক অপরাধের অভিযোগ।
সম্প্রতি টানা তিন মাসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শেখ হাসিনার দোসর, আ’লীগ নেতা মোরশেদ আলমের দুর্নীতির ভয়াবহ তথ্য। এই প্রতিবেদনে তার মালিকানাধীন বীমা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড’-এর কিছু দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরা হলো।
১৯৮৫ সালের ২৩ এপ্রিল কিছু উদ্যোমী ব্যবসায়ীর পরিকল্পনায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে প্রথম বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লি:’। ৬১ লাখ গ্রাহক এই বীমা কোম্পানিটির পলিসি হোল্ডার।
যথাসময়ে গ্রাহকের বীমা দাবি পরিশোধসহ প্রতিষ্ঠানটি যখনই বীমা সেক্টরে আস্থার জাযগা তৈরি করে নেয়-তখনই এর ওপর লোভাতুর চোখ পড়ে বেঙ্গল গ্রুপের মালিক মোরশেদ আলমের। তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠানটিকে কব্জায় নিতে। প্রথমে তিনি শেয়ার কেনেন। আ’লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার দু’বছরের মাথায় ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বোর্ডে প্রবেশ করেন। সাধারণত: ২শতাংশ শেয়ার থাকলে পরিচালনা পর্ষদে নাম থাকার কথা। অথচ ৮ শতাংশ শেয়ার থাকা সত্ত্বেও উদ্যোক্তা পরিচালক আহম্মেদ আলীর পরিবারকে অবান্তর জটিলতা সৃষ্টি করে মোরশেদ আল কৌশলে পরিচালনা পর্ষদের বাইরে রাখেন। এছাড়া বোর্ডের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পরিচালক মো: মতিউর রহমান এবং মো: মজিবুর রহমানকে চেয়ারম্যান হতে দেননি। তারা যাতে ন্যাশনাল লাইফে কোনো ধরণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন সে লক্ষ্যে তুচ্ছ কারণে দুদককে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করান।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে মোরশেদ আলমসহ ১৭ জন পরিচালক রয়েছেন। তারা হলেন, চেয়ারম্যান মো: মোরশেদ আলম। ভাইস চেয়ারম্যান তাশমিয়া আমবারীন। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন, বিলকিস নাহার, এএসএম মঈনুদ্দীন মোনেম, এয়ার কমোডর (অব.) মো: আবু বকর (এফসিএ), ফারজানা রহমান, লতিফা রানা, মো: শহিদুল ইসলাম চৌধুরী, কাজী মাহমুদা জামান, ড. শামীম খান, মো: মতিউর রহমান, মো: মজিবুর রহমান, প্রকৌশলী আলী আহমেদ, মাশফিকুর রহমান, নাহরীন রহমান, জাকির আহমেদ খান ও ইফতেখার আলী খান।
এদের মধ্যে তাশমিয়া আমবারীন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শওকত আলীর স্ত্রী। এসএম মঈনউদ্দীন হচ্ছেন মোনেম কনস্ট্রাকশন লি:’র অন্যতম মালিক। তিনি মোরশেদ আলমের কথায় উঠ-বস করেন। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী কাজী হাবিব জামানের স্ত্রী মাহমুদা জামান। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলাম চৌধুরী।
তবে উদ্যোক্তা পরিচালক মরহুম আহম্মেদ আলীর স্ত্রী তাহেরা আক্তার এবং সন্তানদের কাউকেই মোরশেদ পরিচালনা বোর্ডে প্রবেশ করতে দেননি।
শর্ত ছিল দুই বছর পরপর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদে পরিবর্তন হবে। সেই হিসেবে পরিচালনা পর্ষদে থাকা সব পরিচালকেরই পর্যায়ক্রমে ন্যাশনাল লাইফের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। কিন্তু মোরশেদ আলম অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে নিজের কব্জায় রেখেছেন চেয়ারম্যান পদ। শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো না-ইত্যাদি ধুয়া তুলে নিজেই চেয়ারম্যান পদে থেকে গেছেন। তিনি একাই ন্যাশনাল লাইফে ছড়ি ঘুরিয়েছেন। একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি লাখ লাখ গ্রাহকের অর্থ নিয়ে নয়-ছয় করেছেন নিজের ইচ্ছেমাফিক।
ন্যাশনাল লাইফের মোরশেদের দুর্নীতি
পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর মোরশেদ আলম এবং তার সন্তানেরা ন্যাশনাল লাইফে মেতে ওঠেন বহুমাত্রিক দুর্নীতিতে। নানাভাবে আত্মসাৎ করেন কোম্পানির টাকা। রাজধানীর পান্থপথে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দেড় বিঘা আয়তনের একটি প্লট ছিল। এই প্লটটি তিনি বিক্রি করেন প্রায় দেড় শ’ কোটি টাকায়। অথচ দলিলে উল্লেখ করেন ৮০ কোটি টাকা। ক্রেতার কাছ থেকে তিনি দেড় শ’ কোটি টাকা আদায় করলেও ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে দেখান ৮০ কোটি টাকা। বাকী ৭০ কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন।
অন্যদিকে, নিজের সম্পত্তি কোম্পানির কাছে বিক্রির ক্ষেত্রেও করেন বিপুল অর্থ আত্মসাৎ। নিজ নির্বাচনী এলাকা নোয়াখালির চৌমুহনিতে মোরশেদ আলম তার ব্যক্তিগত ভবনের ফ্লোর দ্বিগুণ দামে বিক্রি করেন ন্যাশনাল লাইফের কাছে। এক্ষেত্রে তিনি আত্মসাৎ করেন ৬০ কোটি টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারস্থ ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স ভবনের সামনে একটি প্লট ছিলো। বিরোধপূর্ণ এই সম্পত্তিতে ওয়ারিশ নিয়ে ঝামেলা ছিল। এই প্লটটি মোরশেদ প্রথমে স্বল্প দামে নিজের নামে ‘ক্রয়’ করেন ৪০ কোটি টাকায়। সে ক্রয়ের অর্থ পরিশোধ করেন ন্যাশনাল লাইফ কোম্পানির তহবিল থেকে। নিজের নামে কেনা সেই জমি পরে ন্যাশনাল লাইফের কাছে ‘বিক্রি’ করেন ৬০ কোটি টাকায়। এখাতে তিনি ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। বিরোধপূর্ণ এই জমি নিয়ে জনৈক জসিমউদ্দিনের ওয়ারিশদের সঙ্গে এখনো মামলা ঝুলছে।
লোকসান দেখিয়ে আত্মসাৎ
২০১৭ সালে বাংলাদেশ ট্রেজারি বন্ডে মোরশেদ আলম বিনিয়োগ করেন কোম্পানির ৯৬৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বন্ড ক্রয়ের লক্ষ্যে আরও ৪১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা অগ্রিম পরিশোধ করেন। বছরখানেক পর ২০১৮ সালে ধরা পড়ে যে, বিনিয়োগের জন্য রাখা অ্যাডভান্সের ৪১ কোটি ৪৬ লাখ থেকে ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ৩৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা ‘অগ্রিম’ হিসেবে আছে। ৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বন্ডে বিনিয়োগ করলে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ হওয়ার কথা ৯শ’ ৭৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। কিন্তু বিনিয়োগ না বেড়ে ২০১৭ সালে ৯শ’৬৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা থেকে বরং ২ কোটি টাকা কমে যায়। ২০১৮ সালে ৯৬৭ কোটি ১৮ লাখ টাকায় নেমে আসে। ৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকার বন্ড বিক্রি করা হয়েছে কিনা এ-সংক্রান্ত কোনো ব্যখ্যা প্রতিষ্ঠানটির কাছে নেই। অর্থাৎ ন্যাশনাল লাইফ থেকে মোরশেদ আলম ট্রেজারি বন্ডের ৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
মোরশেদ আলম অর্থ আত্মসাৎ করেন রি-ইন্স্যুরেন্সের অর্থও। ২০২১ সালের ৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা রি-ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রাপ্ত দাবি, কমিশন এবং প্রফিট কমিশন মূল আয়ে না দেখিয়ে তিনি আত্মসাৎ করেন। প্রতিবছর রি-ইন্স্যুরেন্সের প্রতিষ্ঠানের আয়ের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে রি-ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়ামের সঙ্গে সমন্বয়ের দাবি করা হচ্ছে। এতে বছর বছর বাড়ছে প্রতিষ্ঠানের দায়। কমিশন এজেন্ট, গ্রাহকের বীমা দাবি, এজেন্ট লাইসেন্স ফি পরিশোধ না করে জমিয়ে রেখেছেন।
মোরশেদ তার প্রতিষ্ঠানের বীমা দাবি আটকে রাখার মাধ্যমে লঙ্ঘন করছেন বীমা আইন। ২০১০ সালের বীমা আইনের ৭২ নম্বর ধারা এবং এজেন্ট লাইসেন্সের ফি’র বীমা এজেন্ট (নিয়োগ, নিবন্ধন ও লাইসেন্স) প্রবিধানমালা ২০২১ এর ৯ নম্বর নির্দেশনা লঙ্ঘন করেন তিনি।
কোম্পানির নামে নিজের সম্পদ বৃদ্ধি
মোরশেদ আলম কোম্পানির সম্পদ বৃদ্ধির নামে মূলত: নিজের ব্যক্তিগত সম্পদই শুধু বাড়িয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত সম্পদের পর্বত। তিনি বিভিন্নখাতে কোম্পানির ৪শ’ কোটি টাকা ‘বিনিয়োগ’ দেখিয়েছেন। আর এসব বিনিয়োগখাতের অধিকাংশই ভুয়া, অস্বচ্ছ ও গোজামিলে ঠাঁসা।
মোরশেদ আলম নানা অজুহাতে গত ১৩ বছর ধরে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান পদ কব্জায় রেখেছেন। এই সময় তিনি আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে শত শত কোটি টাকা লুট করেন। লুটপাটের উল্লেখযোগ্য একটি খাত হচ্ছে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ। বিগত চার বছরেই ন্যাশনাল লাইফ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন ৯৭ কোটি ১৭ লাখ ৬৪ হাজার ৪৯৩ টাকা। জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কিনে লোকসান দেন ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা।
অথচ বীমা প্রবিধানমালা ২০১৯ অনুযায়ী বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন অনুমোদিত কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ে শর্ত দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বীমা কোম্পানি জেড ক্যাটাগরিভুক্ত কোনো শেয়ার কিনতে পারবে না। অথচ মোরশেদ আলম চার বছরে জেড ক্যাটাগরি কোম্পানির শেয়ার কিনে ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনে লোকসানকে ‘আত্মসাৎ’ হিসেবে দেখা হয়।
২০১৮ সালে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত, অতালিকাভুক্ত মিলিয়ে ১১১টি কোম্পানিতে ৬ কোটি ৮৪ লাখ ২৬ হাজার ৫২৩ টি শেয়ার কেনেন মোরশেদ। টাকা বিনিয়োগ করেন ২শ’ ১ কোটি ৬০ লাখ ১১ হাজার ৭৬৩ টাকা। ১১১টি কোম্পানির মধ্যে ২০১৮ সালে শেয়ার বেড়েছে মাত্র ১৪টি কোম্পানির। স্থিতিশীল ছিল ১৪টির। শেয়ারের দাম কমেছে ৮৩টি কোম্পানির। ৬৪ কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ায় ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির লোকসান হযেছে ১৪ কোটি ৮১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৯১ টাকা। ২০১৯ সালে শেয়ার বাজারে লোকসান দেয় ৫১ কোটি ৩৪ লাখ ৭ হাজার ৮৫৯ টাকা। ২০২০ সালে লোকসান দিয়েছে ২৫ কোটি ৫৮ লাখ ১৩ হাজার ৭০২ টাকা। সর্বশেষ ২০২১ সালে মোরশেদ নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৪১ টাকা।
আর্থিক প্রতিবেদনে প্রতিবছরই বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে-মর্মে দাবি করা হয়। তার দাবি মতে, ২০১৬ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী মোরশেদ আলম ন্যাশনাল লাইফের বিনিয়োগ দেখান ৩ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে ২০১৬ সালের বিনিয়োগ উল্লেখ করেন ৩ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে বিনিয়োগ দেখান ৩ হাজার ২৪০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে ২০১৭ সালে করা বিনিয়োগের অঙ্ক উল্লেখ করেন ৩ হাজার ৩৩৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ এখানে ৯৩ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে দেখিয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে আরও ১৭৬ কেটি টাকা বাড়িয়ে দেখিয়েছেন ২৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। একইভাবে ২০১৮ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে বিনিয়োগ দেখান ৩ হাজার ৩৯৯ কোটি ৫৯ টাকা। ২০১৯ সালে সেটি বাড়িয়ে দেখান ৩ হাজার ৬০৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এভাবে আর্থিক প্রতিবেদনের পাতায় পাতায় রয়েছে হিসেবের গোজামিল তথা মোরশেদ আলম গংয়ের আত্মসাতের স্বাক্ষর।
প্রকাশ করা বছরওয়ারি আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারেই মোরশেদ আলম ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে গ্রাহকের ২০৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। এটি ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই ধারায় অপরাধ প্রমাণিত হলে মোরশেদ আলম এবং তার সহযোগীরা সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কিংবা ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডসহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৯৪৭ সালের ৫(২) ধারার সঙ্গে দন্ডবিধির ৪০৯ এবং ১০৯ ধারা যুক্ত করে মামলা করতে পারে। এছাড়া বীমা আইনের ১৩১ ধারা অনুযায়ী ৩ বছর কারাদণ্ড এবং ৫ লাখ টাকা অর্থ দন্ড হতে পারে।
মোরশেদ আলম প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করতেন না। সাধারণত: একই ব্যক্তি দু’টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক থাকতে পারেন না। কিন্তু মোরশেদ আলম একাধারে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ডিরেক্টর থাকার অবস্থায় ন্যাশনাল লাইফের ডিরেক্টর ছিলেন। বীমা আইনের ৭৫ ধারা লঙ্ঘন করে একই সঙ্গে ব্যাংক এবং বীমা কোম্পানির পরিচালক পদ দখলে রাখেন তিনি। যদিও তিনি মার্কেন্টাইল ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছেন-মর্মে দাবি করেন। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় কথিত পদত্যাগটি ছিল ভুয়া। আওয়ামী লীগের টিকিটে তিনি তিনবার এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন দু’টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালক (লাভজনক পদ) পদে বহাল থেকেই।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো: মইদুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বীমা কোম্পানির চেয়ারম্যান-পরিচালকসহ সব কর্মকর্তা কর্মচারী ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ হিসেবে গণ্য। তাছাড়া গ্রাহকের জামানত কিংবা আমানতের অর্থও ‘পাবলিক মানি’ হিসেবে স্বীকৃত। তাই উভয় বিবেচনায় অর্থ আত্মসাতের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪, মানিলন্ডারিং আইন এবং ফৌজদারি দন্ডবিধির ধারা সমুহ প্রযোজ্য। যারাই প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক রয়েছেন, তারা প্রত্যেকে এই আইনে দায়ী হবেন।
এদিকে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান মোরশেদ আলমের দুর্নীতির বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মুখ্য নির্বাহী মো: কাজিমউদ্দিনের সঙ্গে। একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাকে এসএমএস পাঠানো হয়। তাতেও তিনি সাড়া দেননি।
Unauthorized use or reproduction of The Finance Today content for commercial purposes is strictly prohibited.